রাজনীতি, সন্ত্রাস ও নৈতিক পতন: একটি ভয়াবহ বাস্তবতা

একটি বিভৎস হত্যাকাণ্ড, এক ঝলক গণচেতনার অবনমন
পুরান ঢাকার সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডটি এক বিভৎসতার প্রতিচ্ছবি। ঢাকাবাসী, এমনকি সমগ্র বাংলাদেশ, এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড অনেক দিন পর প্রত্যক্ষ করল। সর্বশেষ যে দৃশ্যটি মানুষকে এমনভাবে হতবাক করেছিল, তা ছিল বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ঘটনা। আমরা একটি সভ্য, সাংবিধানিক রাষ্ট্রে বাস করি—কিন্তু যেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ পাথর দিয়ে থেতলে হত্যা করে, তা কেবল রাষ্ট্রের আইনের শাসন নয়, সমাজের নৈতিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অপরাধীদের দায় অপরিহার্য, দলীয় পরিচয় নয়
যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত—তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তারা কোন দলের, কোন মতের, বা কোন পরিচয়ের—তা গৌণ বিষয়। অপরাধী মানেই অপরাধী। বিএনপি হোক বা আওয়ামী লীগ—কোন দলেরই কারো অপরাধে প্রশ্রয় দেওয়ার অধিকার নেই।
তবে এই প্রশ্নও উঠে এসেছে, এই নৃশংস ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক প্রশ্রয় ছিল কিনা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিরা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ ছিল না বলেও শোনা যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এই ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সত্য বের করাটাই জরুরি, গুজব ছড়ানো নয়।
যুব রাজনীতি কি আদর্শ থেকে বিচ্যুত?
একটি স্পষ্ট প্রশ্ন সামনে এসেছে—বাংলাদেশে যুব রাজনীতি আদর্শ হারিয়ে ফেলেছে কি?
এক সময় যে রাজনীতিতে ছাত্র-যুবকরা জাতি গঠনে নেতৃত্ব দিত, আজ তা রূপান্তরিত হয়েছে নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব ও চাঁদাবাজির লড়াইয়ে। ঢাকার ঘটনার পেছনে যদি যুবদলের অংশগ্রহণ থাকে, তবে তা গভীর উদ্বেগের বিষয়।
তবে এটাও সত্য, বিএনপি অতীতে বহুবার নিজেদের দলীয় কর্মীদের অপকর্মে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন প্রয়োজন আরও কঠোর, দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ।
বিচার হোক, ব্লেইম গেম নয়
দায় চাপানোর রাজনীতি এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। কেউ যদি বলে এই দায় কেবল বিএনপির, তাহলে প্রশ্ন আসে—দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায় কার?
সরকারের অধীনে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন—সবই সক্রিয়। তারা যদি এমন একটি হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে দায় কেবল বিরোধী দলের নয়, সরকারেরও।
পরিসংখ্যান যা বলছে, তা আরো ভয়াবহ
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় খুনের সংখ্যা ছিল ১৩৬, যেখানে ২০২৪ সালে একই সময়ে ছিল মাত্র ৪৭। সারাদেশে এই সংখ্যা পৌঁছেছে ১,২৪৪-তে। এ এক বিপজ্জনক ধারা, যা স্পষ্টভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি তুলে ধরে।
বিএনপির অবস্থান: অপরাধীদের প্রতি জিরো টলারেন্স
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবসময় আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই ঘটনায় দলীয়ভাবে জড়িত কেউ থাকলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না, এটাই দলের স্পষ্ট বার্তা।
কিন্তু, পাশাপাশি এ কথাও বলা জরুরি—যারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে অপরাধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের উদ্দেশ্যও জনবিরোধী।
ক্ষমতায় আসার আগেই ধ্বংসের প্রক্রিয়া?
বিএনপি কি নিজেরা বুঝতে পারছে না যে ক্ষমতা যতটা কাছে মনে হচ্ছে, বাস্তবে তারা তার চেয়েও বেশি দূরে চলে যাচ্ছে?
রাজনীতির এক নতুন সংস্কৃতি দরকার যেখানে আদর্শ, মানবিকতা, এবং নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট থাকবে।
যারা গ্রুপ রাজনীতি করে, তাদের গ্রুপ রেস্পন্সিবিলিটিও নিতে হবে। শুধু ৩-৫ জনকে বহিষ্কার করে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। পুরো স্ট্রাকচারকে পরিষ্কার করা জরুরি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
পুলিশ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে বিকল্প বাহিনী, যেমন সেনাবাহিনী বা বিশেষ টাস্কফোর্সের সহায়তা নেওয়া উচিত। অপরাধীদের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দ্রুত শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে হবে। যারা পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য শিক্ষা ও পুনর্গঠন প্রয়োজন
রাজনীতি যদি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, তাহলে সেই রাজনীতি মানুষের শত্রুতে পরিণত হয়।
বিএনপিকে বুঝতে হবে—আজকের তরুণ প্রজন্ম আর “২০০১ সালের বিএনপি” চায় না। তারা চায় নতুন নেতৃত্ব, আধুনিক ভাবনা, এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামো।
তাই পুরনো স্ট্রাকচার ভেঙে নতুন প্রজন্মকে জায়গা দিতে হবে—যোগ্যদের সামনে আনতে হবে।
উপসংহার: মানুষ নিরাপত্তা চায়, বিভক্তি নয়
বাংলাদেশের মানুষ আর চায় না রক্তের রাজনীতি। তারা চায় নিরাপত্তা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আজ যারা রাজনীতির নামে পেশিশক্তির আশ্রয় নিচ্ছে—তারা যেন মনে রাখে, জনগণের ঘৃণা একবার তৈরি হলে তা আর থামে না।
এই জাতিকে রক্ষা করতে হলে, রাজনীতিকদের আত্মসমালোচনা, সততা ও সংস্কার-প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে।
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
চেয়ারম্যান – বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র
চেয়ারম্যান – ডেমোক্রেসি রিসার্চ সেন্টার (ডিআরসি)