বিএনপির রদবদলে ফ্যাক্টর ‘কমিটমেন্ট’ শিগগির আরও পরিবর্তন

বিএনপির রদবদলে ফ্যাক্টর ‘কমিটমেন্ট’ শিগগির আরও পরিবর্তন

ঈদুল আজহার আগে হঠাৎ করেই নির্বাহী কমিটিতে বড় ধরনের রদবদল করেছে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন ৪৫ নেতা। এই রদবদলের নেপথ্যে সাধারণভাবে বিগত আন্দোলনে রাজপথে ভূমিকার বিষয়টি আলোচনায় এলেও মূলত দল ও নেতৃত্বের প্রতি কমিটমেন্টই ‘মূল ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করেছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তাদের মতে, ‘আস্থাভাজন’ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাহী কমিটির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চান দলের হাইকমান্ড। এ বিবেচনায় রদবদলে কারোর পদোন্নতি হয়েছে, কারোর পদাবনতি ঘটেছে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে ‘পদোন্নতি’ দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে অবনমন হয়েছে বলেও মূল্যায়ন তাদের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও অঙ্গ সংগঠন পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে বিএনপি।

 এই প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত তরুণ ও দলের হাইকমান্ডের আস্থাভাজন নেতাদেরই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আনা হবে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, শিগগিরই নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে আরও পরিবর্তন আসতে পারে। দ্বিতীয় ধাপে ৩০ থেকে ৩৫ নেতাকে বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হতে পারে। এক্ষেত্রে ভাইস চেয়ারম্যান ছাড়াও স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে নতুন মুখ আসতে পারে। জানা গেছে, বয়স ও অসুস্থতাজনিত কারণে দু-একজন নিষ্ক্রিয় হলেও স্থায়ী কমিটি থেকে আপাতত কাউকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা নেই বিএনপির। দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকা পদগুলো পূরণ করাই মূল টার্গেট দলের। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে। তৃতীয় এবং চতুর্থ ধাপ মিলিয়ে দুই থেকে আড়াইশ পদে আসতে পারে রদবদল। বিএনপির ৪৫ পদে রদবদল নিয়ে দলে দুই ধরনের মত রয়েছে। একপক্ষ বলছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও নানা কারণে আপাতত কাউন্সিল করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিভিন্ন পদ পুনর্বিন্যাস করছেন। যেহেতু একই পদে কারও বেশিদিন থাকার সুযোগ নেই, তাই পদোন্নতি দিয়ে সেই শূন্য পদে যোগ্যদের পদায়ন করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় দল যাকে যেখানে প্রয়োজন বলে মনে করছে, তাকে সেখানে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি স্বাভাবিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। অন্যপক্ষ বলছে, দল পুনর্গঠনের লক্ষ্যে যে রদবদল আনা হয়েছে তাতে এটা সুস্পষ্ট যে, বিগত আন্দোলনে যারা মাঠে ছিলেন না কিংবা নেতৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন করেছেন অথবা দলের প্রতি যাদের কমিটমেন্টের অভাব রয়েছে বলে হাইকমান্ডের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, তাদের অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন পদ কিংবা পদাবনতি দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, যুগ্ম মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা পাঁচজনকে পদোন্নতি দিয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়া হয়েছে। তারা হলেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হারুন অর রশিদ ও আসলাম চৌধুরী। এ ছাড়া চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ও ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন, সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বেবী নাজনীন, সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন চৌধুরী ফাহিন এবং মেজর জেনারেল (অব.) মো. শরীফ উদ্দীন। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদটি দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদমর্যাদার হলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ পদটি অনেকটা আলংকারিক।

এটি অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন বলে বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে বিবেচিত। তাদের মতে, খোলা চোখে পদোন্নতি মনে হলেও কার্যত দলে তাদের গুরুত্ব কমেছে। এদিকে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন চৌধুরী ফাহিনের অন্তর্ভুক্তিকে ‘অতিমূল্যায়ন’ হিসেবে দেখছেন নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া এস এম সাইফ আলীকে সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক করাকেও ‘অতিমূল্যায়ন’ বলছেন তারা। বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মতে, একজন আনকোরা ব্যক্তিকে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হয়েছে। রদবদলে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে পাঠিয়ে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন শওকতকে রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। এই পদক্ষেপকেও ‘অতিমূল্যায়ন’ মনে করছেন অনেকে। তাদের মতে, বিগত আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা না থাকলেও দলের একজন প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জালাল উদ্দিন মজুমদার (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিভাগ), সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, রংপুর বিভাগ), সায়েদুল হক সাঈদ (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, কুমিল্লা বিভাগ), চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক (সহ-কৃষিবিষয়ক সম্পাদক) এবং এস এম গালিবকে (সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক) বর্তমান পদ হতে নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে নিয়ে আসা চরম অবমূল্যায়ন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীদের একাংশ। সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলন মূল্যায়নে কূটনৈতিক ব্যর্থতা কাটাতে দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির বদলে ২৯ সদস্যের নতুন দুটি কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। জ্যেষ্ঠ নেতাদের সমন্বয়ে একটি এবং তাদের সহায়তা করার জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু দুটির কোনোটিতেই রাখা হয়নি আগের কমিটির সদস্য রুমিন ফারহানাকে। এর কারণ সম্পর্কে বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু দলের এমপিরা পদত্যাগের ব্যাপারে প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। দু-একজন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য হাইকমান্ডকে বোঝানোরও চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্য দলের চূড়ান্ত নির্দেশ আসার পর সবাই সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু পদত্যাগের পর একজন ছাড়া বাকিরা দলীয় ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি হাইকমান্ড। সে কারণে রুমিন ফারহানার ওপর দল আস্থা রাখেনি। সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদকে যুগ্ম মহাসচিব থেকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করার পেছনেও একই বিষয় কাজ করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ১৩ জুন রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা ছিল, ঈদের আগেই সেখানে নতুন কমিটি দেওয়া হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। যে কোনো সময় সেখানে আংশিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হবে। কীভাবে সেই কমিটি দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে হাইকমান্ড। সম্ভাব্য পদপ্রত্যাশীরাও শেষ মুহূর্তের লবিং-তদবিরে ব্যস্ত। জানা গেছে, বর্তমানে যারা কারাগারে ও দেশের বাইরে রয়েছেন নেতৃত্বের জন্য তাদের বিবেচনা করছে না দল। দীর্ঘদিন ধরে বয়স্করা মহানগরের নেতৃত্ব দিলেও এবার তরুণদের ওপর আস্থা রাখতে চায় হাইকমান্ড। এদিকে মহানগর উত্তর বিএনপি নিয়ে দলটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সেখানে নেতৃত্বের ব্যাপক সংকট রয়েছে। দু-একজন ছাড়া নতুন নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যারা আছেন, তারা বয়স্ক। দলে তাদের খুব একটা অবস্থান নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি পদে বিদায়ী কমিটির সদস্য সচিব আমিনুল হকের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

 এ পদে যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে নীরব কারাগারে থাকায় তার সম্ভাবনা কম বলে অনেকে মনে করেন। সাধারণ সম্পাদক পদে যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীরের নাম আলোচনায় রয়েছে। অবশ্য দলের প্রভাবশালী কিছু নেতা নীরব ও জাহাঙ্গীরকে দিয়ে কমিটি গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে বিদায়ী কমিটির কয়েকজন নেতা বলেন, তারা উত্তর বিএনপির বিদায়ী কমিটির নেতাদের দিয়েই নতুন কমিটি চান। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে দলের হাইকমান্ডের কাছে এই দাবি জানিয়েছেন তারা। এদের বাইরে সাধারণ সম্পাদক পদে বিদায়ী কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এজিএম শামসুল হক, আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন, আতাউর রহমান চেয়ারম্যান এবং উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম কফিল উদ্দিন আহম্মেদের নাম আলোচনায় রয়েছে। উত্তরের বিদায়ী কমিটির দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা সদস্য এবিএমএ রাজ্জাকও পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। এদের বাইরে বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য তাবিথ আউয়ালের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে মহানগর দক্ষিণে নেতৃত্বের তেমন কোনো সংকট নেই। বিদায়ী কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে সভাপতি ও যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিনকে সাধারণ সম্পাদক অথবা দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সহসভাপতি হামিদুর রহমান হামিদ ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুর রশিদ হাবিবকে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের সম্ভাবনা বেশি। এমনকি এই চারজনই সুপার ফোরে থাকতে পারেন। এদের বাইরে সদ্য বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ইশরাক হোসেনের নামও শোনা যাচ্ছে। জানা গেছে, যুবদলের নতুন আংশিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখন শুধু ঘোষণার অপেক্ষায়। সেখানে বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্নার সভাপতি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। এ ছাড়া সভাপতি হিসেবে বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসানের নামও আলোচনায় রয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে বিদায়ী কমিটির সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। এ ছাড়া ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানও সাধারণ সম্পাদকের আলোচনায় রয়েছেন।

 এদের বাইরে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ও কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান শ্যামল ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলের নামও আলোচনায় রয়েছে। এরা সুপার ফাইভে থাকতে পারেন। জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘দলের নির্বাহী কমিটিতে কিছু শূন্য পদ পূরণ এবং কিছু পদে সমন্বয় করা হয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদেও কয়েকজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে এই পদায়ন করা হয়েছে। এটি রুটিন ওয়ার্ক। আগামীতে আরও রদবদল হবে কি না, সেটা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলতে পারবেন।’