ইতিহাসে শেখ মুজিবের ভূমিকা ঘিরে কেন এত বিতর্ক

বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান কোথায়- এখন এমন প্রশ্নে চলছে বিতর্ক, চলছে নানা আলোচনা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে তাকে নিয়ে ছিল একমুখী ইতিহাস তৈরির প্রচেষ্টা। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক বছরে একেবারে উল্টা এবং ভিন্ন ধরনের ধারণা বা বক্তব্য আলোচনায় আসছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটা প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
এমন এক পটভূমিতেই এবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই নেতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টস্টে হত্যার ঘটনার ৫০ বছর পার হলো।
আওয়ামী লীগের শাসনের সময় তার মৃত্যুর এই দিনে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন করা হতো। আগস্ট মাসজুড়েই শোকের মাস হিসেবে পালন করা হতো নানা কর্মসূচি।
এর সবই বাতিল হয়েছে ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায়। তবে এখন দিনটি পালন করতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তিও দৃশ্যমান নয়।
কেন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলো, এর দায় কি আওয়ামী লীগেরই- এসব প্রশ্নেও আলোচনা রয়েছে রাজনীতিতে।
‘হাসিনার প্রতি আক্রোশ থেকে আক্রান্ত মুজিব’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, যদিও শেখ মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনিবার্য চরিত্র, কিন্তু তার সেই অবস্থান নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
গত বছরের ৫ আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। এমনকি ঢাকায় তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি এক্সকাভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় মাটিতে।
ঘটনাপ্রবাহকে দু’ভাগে ভাগ করছেন নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি মনে করেন, স্বতস্ফূর্ত এবং রাজনৈতিক- এই দু’ভাগে ঘটনাগুলো ঘটেছে।
এর ব্যাখ্যায় তার বক্তব্য হচ্ছে, শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘ কতৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী শাসনে ভোটের অধিকার না থাকায় এবং অত্যাচার-নির্যাতনে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘শেখ হাসিনার প্রতি সেই আক্রোশ থেকে আক্রান্ত হন শেখ মুজিব। সে প্রেক্ষাপটে গণ-অভ্যুত্থানের পর পরই ভাঙচুরের ঘটনাগুলো স্বতস্ফূর্ত ছিল। পরে রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠী ভাঙচুর অব্যাহত রেখেছিল। এটি স্বতস্ফূর্ত ছিল না। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা থেকে ওই গোষ্ঠীগুলোর হাতে শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়।’
তবে তিনি মনে করেন, শেখ মুজিবকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না।
তবে পরিস্থিতির দায় আওয়ামী লীগের বলেই মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তার মতের সাথে একমত পোষণ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও অনেকে।
তারা বলছেন, শেখ মুজিবের দু’টি অংশ রয়েছে- একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা হিসেবে; আরেকটি ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত তার শাসন, তখন বাকশাল নামে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে স্বপরিবারের হত্যার পর তখনও তার ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছিল, সঙ্কটে পড়েছিল আওয়ামী লীগ।
সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসেছিল দলটি।
শেখ মুজিবের শাসনকাল নিয়ে আগেও সমালোচনা ছিল, এখনো তা নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এখন ইতিহাসে তার অবস্থান নিয়েই বিতর্ক করা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ বেশিভাগ রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সক্রিয় হওয়া দলগুলোর বেশিভাগ আওয়ামী লীগ-বিরোধী অবস্থানে সক্রিয় রয়েছে।
দায় কি আওয়ামী লীগেরই?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এবং রাজনীতিকদেরও অনেকে আওয়ামী লীগেরই দায় বেশি দেখছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের সময় অতিচর্বণ করে ‘মুজিববন্দনা’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর ইতিবাচক প্রভাবের চেয়ে মানুষ বিরক্ত হয়েছে; অনেক ক্ষেত্রে ক্ষোভও সৃষ্টি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরেও অনেকটা সময় ধরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক চরিত্র চিত্রায়ণের নীতি ছিল না। কিন্তু আগের সরকারের সময় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে একমুখী একজন ব্যক্তিকে আলাদা চরিত্র দেওয়ার প্রকল্প নির্মাণের চেষ্টা ছিল প্রবলভাবে।
তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের অন্য চরিত্রগুলো সেখানে অনুপস্থিত। এমনকি শেখ মুজিবের সাথে অন্য যে চরিত্রগুলো ছিল, তাদেরও বাদ দিয়ে একমুখী ইতিহাস তৈরির প্রচেষ্টা ছিল।’
তিনি উল্লেখ করেন, একমুখী রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণের সেই চেষ্টা কার্যকর হয়নি। কারণ তা ইতিহাস নির্ভর ছিল না; তা এত বেশি সরকার নির্দেশিত ছিল-যা জনগণ গ্রহণ করেনি।
ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিপরীতমুখী পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক রেজা।
একদিকে ছিল একমুখী ইতিহাস তৈরির প্রকল্প, অন্যদিকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের নানা আয়োজন।
শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে বছরব্যাপী ছিল রাষ্ট্রীয় নানা আয়োজন। এরপর ছয় বছর ধরে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এজন্য সাড়ে বার শ’ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি বিভিন্ন অফিস, ব্যাংক এবং এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুজিব কর্নার করা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তারা তখন তোষামোদি করে সুবিধা নিতে নিজেরা উদ্যোগী হয়েও অফিসের এক কোণায় শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা কিছু বই ও ছবি রেখে ওই কর্নার ঘোষণা করেছিলেন।
শেখ মুজিবকে নিয়ে বই লেখারও হিড়িক পড়েছিল। মানসম্পন্ন লেখা ও পাঠকের চিন্তা ছিল না তাতে। অনেক ভূঁইফোড় লেখক কোনোরকম একটা বই ছাপিয়ে সেই বই সরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে দিয়ে কিনিয়ে ব্যবসা করেছেন।
তোষামোদী করে সরকারের সুবিধা নেয়াই মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
‘দলীয় সীমায় আটকে ফেলা হয়েছিল মুজিবকে’
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি। দলটির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করেন, আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তিকে ঘিরেই মনগড়া বয়ান তৈরি করা হয়েছিল। যেখানে ইতিহাসের অন্য নির্মাতাদের স্বীকৃতি নেই।’
ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি দলকে তাৎক্ষণিক সুবিধা দেয়, মসনদে থাকা ব্যক্তিকে স্বৈরাচারী করে তোলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা স্থায়ী ও মঙ্গলজনক হয় না বলে উল্লেখ করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
সিপিবির এই নেতার কথার সাথে সুর মিলিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও বলছেন, শেখ মুজিবকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে দলের সীমানায় আটকে ফেলা হয়েছে। ফলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতা বা জাতীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে ঘিরে বিতর্ক থামানো যায়নি।
বিতর্ক আরো বেড়েছে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকীতেও গুঁড়িয়ে দেয়া ৩২ নম্বর বাড়ির কাছে তার সমর্থকেরা কোনো কর্মসূচি পালন করতে পরছেন না।
গত বছর গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছেন। নেতাকর্মীদের একটা অংশ কারাগারে এবং বড় অংশই দেশে-বিদেশে পালিয়ে আছেন।
এবছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই বেশি হচ্ছে শেখ মুজিবকে নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক।
যদিও ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে বলছেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনা থেকে শেখ মুজিবকে স্মরণ করার ক্ষেত্রেও যে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে নতুন করে এক ধরনের সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে। এটিকে তারা তাদের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটা প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগের কারণে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে, দলটির সেই বাস্তবতাও বিবেচনায় নেয়া উচিত।
নতুন প্রজন্মে বিভ্রান্তি কেন
উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আহসান হাবিব ও মো: আরমান। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে যখন তাদের সাথে কথা হয়। তারা বলছিলেন, এক বছর ধরে শেখ মুজিবের সমর্থনে কেউ এই বাড়িটির ধার কাছে আসতে পারছে না। অথচ এক বছর আগেও এই বাড়িটি ঘিরে থাকত নানা আয়োজন।
তারা শুধু ধানমন্ডির বাড়িটিকে ঘিরেই পরিবর্তন দেখছেন না। তাদের শিক্ষাজীবনেও পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে।
তারা পাঠ্যবইয়ে এতদিন শেখ মুজিবকে যেভাবে পড়েছেন, তাতে তাকে পর্বতসমান একজন মহান নেতা দেখানো হয়েছিল। এখন তা বাদ দিয়ে পাঠ্য বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। শেখ মুজিব সম্পর্কে একবারে ভিন্ন, বিপরীতমুখী ধারণা তাদের দেয়া হচ্ছে।
আহসান হাবিব ও আরমানের বক্তব্য হচ্ছে, তারা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নতুন প্রজন্মের মধ্যে শেখ মুজিবের স্থায়ী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া চেষ্টা ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে শেখ মুজিবকে নিয়ে অনেক নিবন্ধ ও প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছিল। এছাড়া মুজিবের ওপর নানা আয়োজন থাকত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জোর করে চাপিয়ে দেয়ার কারণে আওয়ামী লীগের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে, জুলাই- আগস্ট আন্দোলনের মুল শক্তিই ছিল নতুন প্রজন্ম বা শিক্ষার্থীরা
সূত্র : বিবিসি