ফিরে এল সেই ১৫ অগাস্ট, কী করবে আওয়ামী লীগ?

ফিরে এল সেই ১৫ অগাস্ট, কী করবে আওয়ামী লীগ?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিনটি ফিরে এল ভিন্ন আবহে। তার বড় মেয়ে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বৈরশাসন আর শত শত আন্দোলনকারীকে হত্যার দায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে আছেন ভারতে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার চলছে। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে দমন-পীড়নে অংশ নেওয়ার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। শেখ হাসিনার মতই অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা রয়েছেন আত্মগোপনে। একটি অংশ গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। কর্মীরা সব ছন্নছাড়া।

 

এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু হত্যার ৫০তম বার্ষিকী পালনে ফেইসবুকে কর্মসূচি দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং তাদের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগ। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশে বসে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান রেখেছেন, তারা যেন শুক্রবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। শেখ হাসিনার পতনের ছয় মাস পূর্তির দিনে ‘মুজিববাদের কবর রচনার’ ঘোষণা দিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভেকু দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৫ অগাস্ট ‘নিষিদ্ধ’ আওয়ামী লীগ যেন সেখানে কোনো ধরনের ‘বিশৃঙ্খলা’ করতে না পারে, সেজন্য ৩২ নম্বরে প্রবেশের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিভিন্ন ফেইসবুক পোস্টে ১৫ অগাস্ট কালো ফানুস ওড়ানোর ডাক আসে। সেই কারণ উল্লেখ না করেই ১৪ অগাস্ট রাত ১১টা থেকে ১৫ অগাস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে ফানুস ওড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা দেয় পুলিশ। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে পুরো অগাস্ট মাসজুড়ে নানা আয়োজনে স্মরণ করা হত বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের। ১৫ অগাস্ট ছিল ‘জাতীয় শোক দিবস’, সরকারি ছুটির দিন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেই সরকার পতনের পর দ্বিতীয়বারের মত দিনটি এল রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মসূচি ছাড়াই। গত বছরই (২০২৪ সালে) ১৫ অগাস্টের ছুটি বাতিল করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ফুল দিতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন কয়েকজন আওয়ামী লীগ সমর্থক। এবারও আওয়ামী লীগ সমর্থক সন্দেহে তিনজনকে মারধর করে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। একজন শেখ মুজিব স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে।

তার পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ছেষট্টির ছয় দফা প্রণয়নে শেখ মুজিবকে দেখা যায় নেতৃত্বের ভূমিকায়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি করলে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে ছাত্র-জনতা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন শেখ মুজিব। তার সেই ডাকে বাঙালির রক্তাক্ত সংগ্রামে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। স্বাধীনতার পর শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার পালা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বদলে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ। ৫০ বছর আগে সেই রাতে ঘাতকরা শেখ মুজিব ছাড়াও স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে। সেই রাতেই নিহত হন শেখ মুজিবের বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; তার ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকট আত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু। ধানমণ্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবের দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান। শেখ মুজিবকে জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় দাফন করা হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। ১৫ অগাস্ট: থমথমে রাত পেরিয়ে বিভীষিকার ভোর ২০২৪ সালের গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আক্রান্ত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ভবনটি।

 ভেঙে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর বহু ভাস্কর্য। ২০২৪ সালের গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আক্রান্ত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ভবনটি। ভেঙে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর বহু ভাস্কর্য। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষায় সে সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচার শুরু হয়। চূড়ান্ত বিচার শেষে ২০১০ সালে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২০২০ সালে ফাঁসি হয় আরেক আসামির আবদুল মাজেদের। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর দুই দশকের বেশি সময় শেখ মুজিব ছিলেন অনেকটা বিস্মৃত। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর ১৫ অগাস্টকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শেখ মুজিবকে স্মরণ করার সুযোগ তৈরি হয়। ২০০১ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের পাঁচ বছরে আবারও বাতিল করা হয় সেই শোকের দিবস। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হাই কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সাল থেকে দিনটি আবার জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের পাশাপাশি ঘোষণা হয় সরকারি ছুটি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানা কর্মসূচি পালন করত এই দিনে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকেই ১৫ অগাস্টের জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালের মত শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরকেও এখন ‘স্বৈরশাসনের’ কাল হিসেবে দেখানো হয়। সমালোচকরা এক্ষেত্রে ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার উদাহরণ টানেন। এই বেদীতে এক সময় শ্রদ্ধা জানানো হত বঙ্গবন্ধুর প্রতি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভবনের পাশাপাশি তার প্রতিকৃতিও ভেঙে ফেলা হয়। এই বেদীতে এক সময় শ্রদ্ধা জানানো হত বঙ্গবন্ধুর প্রতি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভবনের পাশাপাশি তার প্রতিকৃতিও ভেঙে ফেলা হয়।

 সে সময় বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বাধীন অংশটি এখন বাংলাদেশ জাসদ নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। শুক্রবার বেলা ১১টায় দলীয় কার্যালয়ে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তারা। দলের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, “জাসদ (যা বর্তমানে বাংলাদেশ জাসদ) বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবাদ সংঘটিত করেছে, বুকের রক্তও ঢেলে দিয়েছে। “বিপ্লবী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটিয়ে বাকশাল ব্যতিত একটি সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠনের ডাক দিয়েছেন তৎকালীন জাসদ নেতৃত্ব। জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমেই সেটি সম্পন্ন করার রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়েছিল জাসদ।” শেখ মুজিবের শাসনকালের সমালোচনা করে বিবৃতিতে বলা হয়, “অপরিণামদর্শী একদলীয় বাকশাল রাজনীতি ও জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে মুছে দিতে চেয়েছে, অন্যদিকে অগ্রিম আঘাত হেনে জনতার অবশ্যম্ভাবী বিপ্লবী গণ-অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার চক্রান্ত করেছে।

 “ফলে গোটা জাতি এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে। জাসদ দ্রুতই এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং বুকের রক্ত দিয়ে খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা আজ আবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে তীব্র ঘৃণা জানাচ্ছি এবং শোক প্রকাশ করছি।” বাংলাদেশ জাসদের নেতারা বলেন, “বাংলাদেশ জাসদ সুস্পষ্টভাবে বলতে চায় যে, ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের অপরাধের কারণে যেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করা যায় না, তেমনি শেখ হাসিনাকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেও খাটো করা যাবে না। “১৯৭৫ সনের এ মর্মান্তিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এদেশের জনগণের যে ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে তার ধারাবাহিকতায় এদেশে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বার বার পরাজিত হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।”