গাজা ‘গণহত্যায়’ জড়িত কোম্পানিগুলোর তালিকা প্রকাশ করল জাতিসংঘ

ফিলিস্তিনে মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক নতুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সেখানে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করতে এবং গাজায় গণহত্যা চালাতে সহায়তা করছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানি।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ফ্রান্সেসকা আলবানিজ নামে জাতিসংঘের এক বিশেষজ্ঞ। তার নতুন প্রতিবেদনটি আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) জেনেভায় একটি সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে, নিজের প্রতিবেদনে ৪৮টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করেছেন ফ্রান্সেসকা আলবানিজ, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট, গুগলের পেরেন্ট কোম্পানি আলফাবেট এবং বহুজাতিক কোম্পানি অ্যামাজনও রয়েছে।
খবর আল জাজিরার। এই কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র ফিলিস্তিনে দখলদারিত্বেই জড়িত না, এগুলো গাজার গণহত্যাতেও সহায়তা করছে বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সেসকা আলবানিজ। জাতিসংঘের এ বিশেষজ্ঞের মতে, এসব কোম্পানি সহযোগিতা করছে বলেই ইসরায়েল এখনও গণহত্যা চালিয়ে যেতে পারছে। গাজা ‘গণহত্যায়’ সহযোগী হিসেবে উঠে এলো যেসব কোম্পানির নাম: যুদ্ধবিমান প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইতালির কোম্পানি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করছে ইসরায়েল।
দখলদার রাষ্ট্রটিকে এ যুদ্ধবিমান সরবরাহে আটটি দেশের কমপক্ষে ১ হাজার ৬০০ কোম্পানি জড়িত। এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন। তবে এই যুদ্ধবিমানের বিভিন্ন অংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি হচ্ছে। ইতালির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিএকে সামরিক খাতের প্রধান সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জাপানের ফ্যানুক করপোরেশন অস্ত্র তৈরির লাইনে ব্যবহৃত রোবট যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে। আরও পড়ুনঃ মিয়ানমারের জান্তাকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে বেলারুশ, দাবি অধিকার গোষ্ঠীর তথ্য সরবরাহ করে ইসরায়েলকে শক্তি যোগাচ্ছে মাইক্রোসফট ও অ্যামাজন ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি ও তাদের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য প্রয়োজনীয় বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সরকারের ব্যবহারের সুবিধা দিচ্ছে প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক অনুমতি ব্যবস্থা আরও কার্যকর হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট এবং অ্যামাজন ইসরায়েলকে তাদের ক্লাউড এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে প্রায় পুরোপুরি প্রবেশাধিকার দিয়েছে, যা ইসরায়েলের তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও নজরদারির ক্ষমতা বাড়িয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিতে সহায়তা করছে আইবিএম ও পালান্টির টেকনোলজিস যুক্তরাষ্ট্রের আইটি প্রতিষ্ঠান আইবিএম ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা সদস্যদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি, দেশটির অভিবাসন ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের বায়োমেট্রিক ডেটাবেজ পরিচালনার দায়িত্বও পালন করছে।
নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের সহযোগিতা আরও বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম পালান্টির টেকনোলজিস। এ প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলি বাহিনীকে ‘স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের’ সক্ষমতা সম্পন্ন ভবিষ্যদ্বাণীমূলক নজরদারি প্রযুক্তি দিয়েছে, যার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় এবং ‘ল্যাভেন্ডার’, ‘গসপেল’, ‘হোয়্যার’স ড্যাডি’ এর মতো এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তু তালিকা তৈরি করা হয়। আরও পড়ুনঃ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকে নিয়ে যা জানাল ইরান দখলদারিত্বে ভূমিকা রাখছে ক্যাটারপিলার, এইচডি হুন্দাই ও ভলভো গ্রুপ বহু প্রতিষ্ঠান বেসামরিক প্রযুক্তি তৈরি করলেও সেগুলো ‘ডুয়াল-ইউজ টুল’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অর্থাৎ একইসঙ্গে সেগুলো দখলদারিত্ব বজায় রাখতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাটারপিলার, লিওনার্দোর মালিকানাধীন রাডা ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ, দক্ষিণ কোরিয়ার এইচডি হুন্দাই এবং সুইডেনের ভলভো গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ বসতি স্থাপন এবং ঘরবাড়ি ধ্বংসে ব্যবহৃত ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে ইসরায়েলকে। ইসরায়েলি দখলকৃত এলাকায় অবস্থিত সম্পত্তি ও হোটেল রুম ভাড়ার মাধ্যমে অবৈধ বসতি স্থাপনে পরোক্ষ সহযোগিতা করছে বাড়িভাড়া প্ল্যাটফর্ম বুকিং ডটকম এবং এয়ারবিএনবিও।
এ ছাড়া, কলম্বিয়া থেকে কয়লা সরবরাহের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখছে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রামন্ড কোম্পানি ও সুইজারল্যান্ডের গ্লেনকোর। জড়িত চীনা কোম্পানিও ইসরায়েলের বৃহত্তম খাদ্য কোম্পানি টনুভার মালিক চীনের ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড, যেটি ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে উৎপাদিত পণ্যে লাভবান হচ্ছে। পশ্চিম তীরের দখলকৃত অঞ্চলে পানি সম্পদ শোষণের জন্য প্রয়োজনীয় ড্রিপ ইরিগেশন প্রযুক্তি সরবরাহ করছে মেক্সিকোর অরবিয়া অ্যাডভান্স করপোরেশনের ৮০ শতাংশের মালিক নেটাফিম কোম্পানি।
আরও পড়ুনঃ ইরানের সঙ্গে সংঘাত নিয়ে কী বলছেন ইসরায়েলের মুসলিমরা ইসরায়েলকে অর্থ জোগাচ্ছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানি জাতিসংঘের নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রেজারি বন্ডও গাজায় চলমান যুদ্ধের অর্থ জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক, যেমন ফ্রান্সের বিএনপি পারিবাস এবং যুক্তরাজ্যের বার্কলেস ইসরায়েলের ঋণ সংকট সামাল দিতে অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে।
এসব কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগকারী হিসেবে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরক ও ভ্যাঙ্গার্ড। বিশ্বের বৃহত্তম সম্পদ ব্যবস্থাপক ব্ল্যাকরক পালান্টির ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, মাইক্রোসফটের ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, অ্যামাজনের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, অ্যালফাবেটের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, আইবিএমের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, লকহিড মার্টিনের ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং ক্যাটারপিলারের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ভ্যাঙ্গার্ড, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্পদ ব্যবস্থাপক, ক্যাটারপিলারের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, শেভরনের ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, পালান্টির ৯ দশমিক ১ শতাংশ, লকহিড মার্টিনের ৯ দশমিক ২ শতাংশ এবং ইসরায়েলি অস্ত্র প্রস্তুতকারক এলবিট সিস্টেমসের ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক। জাতিসংঘের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমে মানবাধিকার লঙ্ঘন এড়ানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই ধরনের কার্যকলাপের জন্য কোম্পানি এবং তাদের কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন।