পৃথিবীকে আঘাত করতে পারে ‘সিটি কিলার’ গ্রহাণু, যা জানাল নাসা

মহাকাশে নতুন কোনো গ্রহাণু শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি এখন আর নতুন কিছু নয় একেবারেই। নাসার মতো বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ও তাঁদের বিজ্ঞানীরা প্রতি বছরই নতুন নতুন গ্রহাণু শনাক্তের ঘোষণা দেন এবং সেগুলোর ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আগ্রহী ব্যক্তি ব্যতীত সাধারণ মানুষ নিত্যনতুন এসব গ্রহাণু নিয়ে আগ্রহ দেখান, এমনটা বলার সুযোগ বোধহয় নেই। তবে গত ডিসেম্বরে চিলির মহাকাশ গবেষণা স্টেশন থেকে শনাক্ত হওয়া ‘২০২৪ ওয়াইআর৪’ (২০২৪ ওয়াইআর ফোর) নামের গ্রহাণুটিকে আর উপেক্ষা করতে পারছে না আপামর পৃথিবীবাসী। কেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক। প্রথমত, ‘২০২৪ ওয়াইআর৪’ নামের গ্রহাণুটির পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষের সম্ভাবনা রয়েছে। সংঘর্ষের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ২২ ডিসেম্বর ২০৩২ এর কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। দ্বিতীয়ত, গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত করলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে পৃথিবীবাসী।
কেননা প্রথমে গ্রহাণুটিকে ছোট মনে হলেও পরবর্তীতে এটি আকারে দ্বিগুণ হয়ে ধরা দেয় বিজ্ঞানীদের চোখে। শুধু তাই নয়, ধেয়ে আসা গ্রহাণুটিতে ৫০০ পরমাণু বোমার চেয়েও বেশি সক্ষমতার জ্বালানী রয়েছে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। ফলে ‘সিটি কিলার’ নামে পরিচিত হয়ে উঠা এই গ্রহাণু আগ্রহের চেয়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে বেশি। তবে পৃথিবীবাসীর মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরাবে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক ব্লগ পোস্ট। গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত পোস্টে ‘২০২৪ ওয়াইআর৪’ গ্রহাণুটি নিয়ে নাসার বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গ্রহাণুটির পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা এখন শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ (০.২৮ শতাংশ)। অর্থাৎ, সম্ভাবনাটা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। অথচ এর এক সপ্তাহ আগেও পৃথিবীর সাথে গ্রহাণুটির সংঘর্ষের সম্ভাবনা ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ- যার কল্যাণে একে এযাবৎকালের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গ্রহাণু হিসেবেও গণ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। উল্লেখ্য, একটি গ্রহাণুর পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষের সম্ভাবনায় তারতম্য হতে পারে কেননা বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও ক্যালকুলেশনের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের মতামত পরিবর্তন করে থাকেন।
প্রাথমিকভাবে গ্রাউন্ড স্টেশনের বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট একটি গ্রহাণুর গতিপথ শনাক্ত করার পর গবেষকরা সৌর জগতের আরও উচ্চ ক্ষমতার প্রিসিশন মডেল ব্যবহার করে এর ভবিষ্যৎ গতিপথ অনুমান করে থাকেন। বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ ডেটা যত বেশি হবে তাঁদের অনুমানও তত সঠিক হবে। গ্রহাণুর মতো নিয়ার আর্থ অবজেক্টসমূহ (এনইও) দীর্ঘমেয়াদে পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরুপ। এই বিবেচনা থেকেই বিশ্বের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো পৃথিবীর ওপর নিয়ার আর্থ অবজেক্টের সম্ভাব্য প্রভাব প্রশমন করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। বিভিন্ন দেশের জাতীয় মহাকাশ সংস্থার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে স্পেস মিশন প্ল্যানিং অ্যাডভাইসরি গ্রুপ (এসএমপিএজি), যাদের কাজ হচ্ছে গ্রহাণুর সম্ভাব্য হুমকি মূল্যায়ন করে তার সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একটি গ্রহাণু ৫০ মিটার ব্যসের (ডায়ামিটার) বড় হলে এবং পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে এটির পৃথিবীতে আঘাত করার সম্ভাবনা ১ শতাংশের বেশি হলে এসএমপিএজি গ্রুপের বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটি ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব প্রশমনে উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। গ্রহাণুর মতো নিয়ার আর্থ অবজেক্ট থেকে পৃথিবীকে রক্ষার বেশ কয়েকটি কৌশল রয়েছে।
এরকমই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে কাইনেটিক ইমপ্যাক্ট- যেখানে পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপিত একটি মহাকাশযানকে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রহাণুর সাথে ধাক্কা খাওয়ানো হয় যাতে করে গ্রহাণুটির গতিপথ বদলে যায় এবং পৃথিবীর সাথে এর সংঘর্ষ না হয়। চীনের ডিপ স্পেস এক্সপ্লোরেশন ল্যাবরেটরির একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার লি হাইয়াং বলেন, ‘আমরা কাইনেটিক ইমপ্যাক্টর কৌশল প্রয়োগ করতে পারি। গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষের জন্য পৃথিবী থেকে একটি প্রোব (মহাকাশযান) পাঠাতে পারি এবং এর গতি সামান্য পরিবর্তন করতে পারি, যার ফলে এটি পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে যাবে। অন্যান্য সম্ভাব্য পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে মাধ্যাকর্ষণ (গ্র্যাভিটি) ট্র্যাক্টর ও বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগে বিচ্যুতি (ডিফ্লেকশন)।’ ‘২০২৪ ওয়াইআর৪’ গ্রহাণুর ক্ষেত্রেও প্রতিরক্ষা কৌশল হিসেবে কাইনেটিক ইমপ্যাক্টের কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এই ধরণের গ্রহাণুগুলো বিপদজনক হলেও আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে থাকে এগুলো।
বিজ্ঞানীরা এখন বিশ্বাস করেন যে, গ্রহাণুগুলোতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম বিবর্তন হয়েছে। সুতরাং, বিভিন্ন গ্রহাণু অধ্যয়ন ও অন্বেষণের মাধ্যমে সৌরজগতের উৎপত্তি ও গ্রহগুলির বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে বিজ্ঞানীদের। এছাড়া পৃথিবীতে বিরল এমন সম্পদও পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে গ্রহাণুতে। ফলে ভবিষ্যতের মহাকাশ অনুসন্ধানে আকর্ষণীয় লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারে গ্রহাণু।
তথ্যসূত্র: নাসা, রয়টার্স