মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও ধর্ষণের মতো অপরাধ থামছে না কেন?

চলতি মাসের ৫ জানুয়ারির ঘটনা। কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকায় দুর্বৃত্তদের দ্বারা এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরী বদরখালী স্টেশন থেকে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা দিয়ে মহেশখালী যাচ্ছিলেন। অটোরিকশাটি বদরখালী সেতুর ওপর আসলে গাড়িচালক গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ার বাহানা দেয়।
সেখানে দুজন যুবক কিশোরীর পথ রোধ করে তাকে ধারালো ছুরি দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে মুখ চেপে ধরে সেতুর পাশে বেড়িবাঁধের প্যারাবনে চার থেকে আটজন মিলে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। এরপর কিশোরী জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে সড়কের পাশে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে বদরখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান।
গত বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও শুরু হয়েছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। বছর শুরু হতে না হতেই নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা এর প্রমাণ বহন করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)–এর তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন।
ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১০৯ জন। এরমধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১ জনকে। আবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতন বিষয়ক তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে সারাদেশে মোট ১ হাজার ১০৬ জন কন্যা এবং ১ হাজার ৪১৯ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৬৭ জন কন্যাসহ ৫১৬ জন। তার মধ্যে ৮৬ জন কন্যাসহ ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ১৮ জন কন্যাসহ ২৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ৫ জন কন্যাসহ ৬ জন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া ৫৮ জন কন্যাসহ ৯৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী তান্ইয়া নাহারের মতে, ‘আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমছে না কিছুতেই। শুধু ধর্ষণ না, গণধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। এমনকি বৃদ্ধের পাশাপাশি শিশুরাও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। যদিও বর্তমানে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ আছে এবং এ আইনের ৯(১) ধারা অনুযায়ী, যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি (মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে) দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। আবার ৯(২) ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে (ধর্ষণের শিকার) নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।
এ ছাড়া যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।এই আইনজীবী ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিচারকাজে জড়িত সবাইকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, অপরাধ প্রমাণে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর নানাবিধ জটিলতা ও অসুবিধার কারণেই আইনের সুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগসহ বিচারিক প্রতিটি স্তরকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।আইনজীবী তান্ইয়া নাহার মনে করেন, ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, আবার মানুষ হত্যার শাস্তিও যেহেতু মৃত্যুদণ্ড, তাই হয়তো এ ধরনের অপরাধে অপরাধীরা শাস্তির তুলনামূলক মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠছে।
তাই ধর্ষণের শিকার যিনি হচ্ছেন, তাকে বিচারকালীন তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে এবং অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতকরণে প্রতিটি পর্বের দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরও বেশি পেশাদারিত্বের এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে সমাজে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। আর এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।