আবার কি আক্রান্ত হতে পারে ইরান

যুদ্ধের উত্তেজনা থেকে মধ্যপ্রাচ্য গত ২৪ জুন থেকেই একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির দিকে এগোচ্ছে। ২৩ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা দেন, এতে সংঘাত দৃশ্যত শেষ হয়েছে, অন্তত এখন পর্যন্ত।
কিন্তু যে ‘যুক্তি’তে ইরানে হামলা হয়েছিল, তা পূরণ না হওয়ায় ফের দেশটিতে হামলার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ট্রাম্প, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানের নেতারা—সবাই দাবি করছেন, সংঘাত থেমেছে তাদের শর্তেই।
তবে আসল ঘটনা কী, ইসরায়েল কী অর্জন করল, ইরান কি নিজের কৌশলগত সম্পদ রক্ষা করতে পারল, আর এই যুদ্ধবিরতিই কি শান্তির পথে যাত্রা? উঠছে এমন নানা প্রশ্নও। কীভাবে শুরু হলো সংঘর্ষ: ২২ জুন ইসরায়েলের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালায়। এরপর ট্রাম্প দাবি করেন, ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে’।
জবাবে ২৩ জুন ইরান মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি আল-উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, মধ্যপ্রাচ্য হয়তো দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধের মুখোমুখি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন, ‘ইসরায়েল ও ইরান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’
শেষমেশ ইসরায়েল সীমিত পরিসরে মধ্যপ্রাচ্যে তার শুরু করা যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে উপকরণ দিয়ে সহায়তা দিয়েছিল, কিন্তু সরাসরি অভিযান চালায়নি। এবার সেই ব্যবধানও ঘুচেছে। তবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল দাবি করে, ইরান থেকে ছোড়া দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তাদের আকাশসীমায় ঢুকেছে এবং সেগুলো প্রতিহত করা হয়েছে।
পরে ইসরায়েল তেহরানের কাছে একটি রাডার স্টেশনে হামলা চালায়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন ট্রাম্প। আরও পড়ুনঃ ট্রাম্পের হুমকির পর‘শেষ পর্যন্ত’ লড়াইয়ের ঘোষণা চীনের ইসরায়েল বহু বছর ধরেই বলে আসছে, ইরান তাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কিন্তু তারা আগে কখনো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসরি হামলা চালায়নি। ১৩ জুন ইসরায়েল সেই সীমারেখা অতিক্রম করে। নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়।
জবাবে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। ইসরায়েলের এ অভিযানকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকে অবৈধ বলে বিবেচনা করলেও দেশটির দাবি, তারা আত্মরক্ষায় এ হামলা করেছে। আবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের সবাই ইসরায়েলের এ দাবির ব্যাপারেও একমত নয় যে, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি বা এ বোমা শিগগির দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে।
তেল আবিব ইরানে এই ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ চালিয়েছে এমন একসময়ে, যখন ইসরায়েল এর আগেই ইরানের আঞ্চলিক মিত্র হুতি বিদ্রোহী (ইয়েমেনে), হামাস (ফিলিস্তিনের গাজায়) ও হিজবুল্লাহকে (লেবাননে) একাধিকবার আঘাত করেছে। বিগত দুই বছরে হামাস ও হিজবুল্লাহ যথেষ্ট দুর্বলও হয়েছে। ইরান কি পারমাণবিক কর্মসূচি রক্ষা করতে পারল: ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপরিভাগে ব্যাপক ক্ষতি করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, স্থাপনার ভূগর্ভস্থ অংশও ধ্বংস করা হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ ‘ইরানকে পরমাণু অস্ত্র দিতে প্রস্তুত বিভিন্ন দেশ’ যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘আইএইএ’-এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল কয়েক মাস পিছিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আইএইএর মতো মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে।
এ ছাড়া আইএইএ বলছে, ইরানের কাছে এখন প্রায় ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। এর ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা এখনো অজানা। ইরানের ওপর আরেকটি হামলার সম্ভাবনা কতটা: ইসরায়েল ও ইরান শুধু যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে, শান্তিচুক্তি হয়নি। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ভবিষ্যতে দুটি সম্ভাব্য পথ খোলা আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রথমত, আবারও আইএইএর তত্ত্বাবধানে পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা এবং একটি নতুন চুক্তি করা; যেমনটা ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় হয়েছিল (জেসিপিওএ)। যদিও সেই চুক্তি থেকে ইরান নয়, যুক্তরাষ্ট্রই একতরফা বেরিয়ে গিয়েছিল (ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে)। এমন চুক্তি করা হলে তেহরানের ওপর তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ কমবে। এ প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় দেশগুলোর একটি ভূমিকা রয়েছে।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি মিলে ২০ জুন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কাল্লাসও। তিনি মার্কিন হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদিও একা ইরানকে আপোসে রাজি করাতে সক্ষম নয়, তবু সংস্থাটি মার্কিন-ইসরায়েলি কড়া অবস্থানের বিপরীতে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিতে পারে।
আরও পড়ুনঃ জেলেনস্কিকে সরাতে চান ট্রাম্প ও পুতিন, কিন্তু ইউক্রেনে কী যুদ্ধকালীন ভোট সম্ভব? এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূরাজনীতির শিক্ষক ইয়োআনিস কোটুলাস বলেন, ‘ইরান কূটনৈতিকভাবে ইউরোপকে জড়ানোর চেষ্টা করবে, সেটি আরও বেশি তত্ত্বাবধানের প্রস্তাব দিয়ে (পারমাণবিক কর্মসূচিতে) এবং এ কর্মসূচির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে।’ তবে ইসরায়েল অতীতে ইরান ও পশ্চিমাদের মধ্যে যে কোনো পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করার চেষ্টা করেছে।
নতুন চুক্তিকেও তারা মেনে নেবে না বলেই মনে হয়। উপরন্তু, ইরান কি চুক্তির পথে হাঁটবে? যখন যুক্তরাষ্ট্র আগের চুক্তি ভেঙে দিয়েছে, পরে আলোচনার শর্তও বদলে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত আলোচনা চলার সময়ই ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় হামলা চালিয়েছে? সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানবিষয়ক অধ্যাপক আলী আনসারি আলজাজিরাকে বলেন, ‘ইরানের ভেতরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পিছু হটার ভাষা অনুযায়ী এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে। তবে দেশটির কিছু কর্মী এরই মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের দাবি তুলেছেন।’
অবশ্য এখন পর্যন্ত ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। সোমবার দেশটির পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি একটি বিল অনুমোদন করেছে, যেখানে আইএইএর সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা স্থগিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ট্রাম্প সামাজিকমাধ্যমে আবারও জোর দিয়ে বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তিনি আবার চালু হতে দেবেন না। এই মৌলিক দ্বন্দ্ব যদি রয়ে যায়, তাহলে সামনে আবারও পাল্টাপাল্টি হামলা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সময়ের ব্যাপারমাত্র।