মোদি-ট্রাম্পের পানে চেয়ে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের রাজনীতির পথ সুগম হবে। এ ক্ষেত্রে তারা সংখ্যালঘু ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। এ ছাড়া ভিসা প্রদানে করারোপ, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলসহ বিভিন্ন ঘটনাকে তারা ইউনূস সরকারের জন্য প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছে। এসবকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে চায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বৈঠকে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনাও নিজেদের পক্ষে গেছে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেকে মনে করেন, মব জাস্টিস, বিভিন্ন হামলাকে ভারত নেতিবাচক হিসেবে দেখছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হতাশ করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করে ড. ইউনূস তার ওপর ভারতের চাপ অনেকটাই সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে দেওয়ার পরও বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, এতে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সমস্যা বোধ করছে না, যা এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সম্ভাব্য বিকল্প ব্যবস্থা থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও বাণিজ্য উপদেষ্টা বিকল্প উপায় নিয়ে পরিষ্কার করেননি, তবে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার যে চাপ অনুভব করছে, সেই ইঙ্গিত তার বক্তব্যে সুষ্পষ্ট। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের জয়কে ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব বিরাজ করতে শুরু করে। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর তার নানা মন্তব্য, ইউএসএইডের অর্থায়ন বন্ধও ইউনূস সরকারের বিপক্ষে গেছে মনে করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আশান্বিত হয়ে ওঠেন।
তবে ট্রাম্প ইউএসএইডের অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জর্জ সরোসের ছেলে ঢাকায় এসে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে। এ ছাড়া ড. ইউনূস নিজে ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ইলন মাস্কের সঙ্গে, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা, যা অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য হতাশার। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম কালবেলাকে বলেন, আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নয় আওয়ামী লীগ, কিন্তু পারিপার্শ্বিভাবে দলটি দেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ।
বর্তমান যে প্রজন্ম আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাদের জন্যই আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন অসম্ভব। সেই সম্ভাবনা দেখলেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাবে। মার্কিনিরা চায় চীনবিরোধী অবস্থানে থাকুক বাংলাদেশ, যার জন্য ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করবে বলে কেউ ভেবে থাকলে তা অলীক কল্পনা। বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিনিরা ভারতকে যে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য কিছু ভাবনার রসদ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, রাজনৈতিক দলের জন্য অভ্যন্তরীণ শক্তিই হচ্ছে প্রধান নিয়ামক।
বহিঃশক্তি দলকে যেমন বাঁচাতে পারে না, তেমনি কাউকে পুনর্বাসনও করতে পারে না। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, যে দলই অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে তাদের পরিণতি ও ভবিষ্যৎ ভালো হয়নি। আওয়ামী লীগ যদি ভুল বুঝতে পারে এবং অনুশোচনা থেকে ক্ষমা চায়, তবেই তাদের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। সর্বোপরি সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণ। আর প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কী রকম সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, সে বিষয়ে তাদের স্বাধীনতা রয়েছে। এদিকে গত রমজানে দেশে দ্রব্যমূল্য সহনীয় থাকার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় এবং ঈদযাত্রা স্বস্তির হওয়ায় তা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দেশের মানুষের মনোভাবেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ফলে ড. ইউনূসকে ৫ বছর ক্ষমতায় রাখার আলোচনাও উঠছে, যা হতাশ করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। এ ছাড়া আওয়ামী লীগই দেশের রাজনীতি থাকবে না কি ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হবে, সে বিষয়েও নেতাকর্মীরা নিশ্চিত নন; কোনো নেতা এখনো এ বিষয়ে এগিয়ে আসেননি। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাও এখন পর্যন্ত কাউকে দায়িত্ব দেননি দল পুনর্গঠনে। সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশার গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ বিএনপির দিকে, আবার কেউ কেউ নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বা অন্যদিকে ঝুঁকছেন। এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু কালবেলাকে বলেন, ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে কি না আমি জানি না। তবে যুক্তরাষ্ট্র গত ১৫ বছরে গণতন্ত্রের সপক্ষে কথা বলেছে। আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপক্ষে তাদের অবস্থান ছিল। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। তারা গণতন্ত্রের জন্য একাত্তরে যেমন যুদ্ধ করেছে, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও তা করেছে। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা তার পক্ষের শক্তির জন্য এ দেশে অন্য দেশের কেউ কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, আমেরিকা ও ভারত আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফেরাতে পারবে না। এটা মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই একটা ব্যর্থ তৎপরতা হবে। আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে গেলে বাংলাদেশকে নিয়েই ফিরতে হবে। এজন্য তাদের ১৬ বছরের যে অপরাধ, গুম-খুন-হত্যাকাণ্ডের যে দায়দায়িত্ব, এগুলো স্বীকার করতে হবে, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং অনুশোচনা-উপলব্ধি এগুলো তাদের বলতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত তারা তাদের আগের অবস্থানকেই ডিফেন্ড করে যাচ্ছে এবং বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত মিছিল, স্লোগানে ফেরার চেষ্টা করছে।
তবে এভাবে চোরাগোপ্তা কায়দায় আওয়ামী লীগ আসলে রাজনীতিতে টিকতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, গুম-খুন ও গণহত্যার অভিযোগে একদিকে আইনি প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত সংশ্লিষ্টদের বিচার চলতে থাকবে; অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে দেশের মানুষের কাছে তাদের বক্তব্য হাজির করতে হবে। দেশের মানুষ, রাজনৈতিক দলগুলো তা কীভাবে নেয়, সামগ্রিক সেই প্রেক্ষিত বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগকে তাদের আগামীর পথচলা ঠিক করতে হবে।