ছাত্রলীগের দুঃসময়ের কর্মী এখন বিএনপি পন্থী পুলিশের ওসি 

ছাত্রলীগের দুঃসময়ের কর্মী এখন বিএনপি পন্থী পুলিশের ওসি 

নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ না ছাত্রদল? নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং পরিচয় নিয়ে প্রবল বিতর্কের মধ্যে পড়েছেন ঢাকার আশুলিয়া থানায় সদ্য যোগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ডাবলু।

“মুজিব সৈনিক এবং ছাত্রলীগের দুঃসময়ের কর্মী” উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম ডাবলু পক্ষে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সাবেক হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ -২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর ইস্যু করা প্রত্যয়ন পত্র প্রকাশ্যে আসায় তা নিয়েই শুরু হয় তীব্র বিতর্ক।


ওই পত্রটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বিব্রত পুলিশ প্রশাসন। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ডাবলুর পুলিশ পরিচিতি নম্বর ৭৮০৬০৯৮৫২১। তিনি রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার বাহাদুরপুর গ্রামের মৃত জলিল মিয়ার ছেলে। এই মুহূর্তে অন্তর্জালে অন্যতম চর্চিত বিষয় হচ্ছে পুলিশের ওসি ডাবলুর রাজনৈতিক পরিচয়। নেটিজেনদের অধিকাংশই মুখর সমালোচনায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়েও সোচ্চার দেখা গেছে অনেককে। আবার ডাবলু “ছাত্রদল নেতা ছিলেন” এমন তথ্য উল্লেখ করে ওসির পক্ষ নিয়েছেন তার অনুসারীরা।

আলোচিত ছাগল-কাণ্ড সামনে আনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাইয়েদ আবদুল্লাহ ফেসবুকে লিখেছেন, “২০২২ সালে যাকে লীগের সংসদ সদস্য সুপারিশ করেছিল যে, সে শেখ হাসিনার একজন নির্ভীক কর্মী। সেই মনিরুল হক ডাবলুকে আশুলিয়া থানার ওসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গতকাল। উল্লেখ্য যে, আশুলিয়া জোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং পুলিশের হাতে এখানে বহু ছাত্র-জনতা মারা পড়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। এসব কিছুর তদন্ত বিঘ্নিত হতে পারে এইরকম শেখ হাসিনার নির্ভীক কর্মীকে ওসি হিসাবে সেখানে রাখলে। ( বলে রাখা ভালো, আশুলিয়ার আগের ওসিও ঝামেলাপূর্ণ ছিলো, তাকে কয়েকদিন আগে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়) কথাটা হল, ডাবলুর মত লোককে ওসি হিসাবে কীভাবে নিয়োগ দিলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? এভাবেই কি সরকারের নতুন বন্দোবস্ত চলছে? BIG SHAME!”


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলকামা আজাদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, “ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের ওপর থেকে সকল আস্থা তুলে নিলাম। সংস্কার দরকার নাই, নির্বাচন দেন ক্ষমতা ছাড়েন। তিনি আরও লিখেন, যেই সাভার-আশুলিয়াতে প্রতিদিন রাজপথে মানুষ মরেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। সেই এলাকায় আপনারা আওয়ামী দলীয় ক্যাডারকে ওসি নিয়োগ করে কাদের সঙ্গে মশকরা করেন? লজ্জা করে না?”

গত ২ মার্চ ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে (নং-৩৭৩) মনিরুল ইসলাম ডাবলুকে বদলি করা হয় আশুলিয়া থানায়। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মনিরুল ইসলাম ডাবলুকে অভিনন্দন ও স্বাগত জানিয়ে পোষ্ট দেবার পর থেকেই ওঠে বিতর্কের ঝড়।

এক পর্যায়ে তার পক্ষে সাবেক হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ -২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর ইস্যু করা এক আধা-সরকারি পত্রটি (ডিও লেটার) নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্যাডে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসাবে দেয়া ওই পত্রে বলা হয়, “আমি মো. নজরুল ইসলাম বাবু, এই মর্মে প্রত্যায়ন করছি যে, মো. মনিরুল হক ডাবলু, পিতা- মরহুম আ. জলিল মিয়া, সাং- বাহাদুরপুর, থানা- গোয়ালন্দ, জেলা- রাজবাড়ী। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে সে কৃতিত্বের সহিত ফলাফল করে উত্তীর্ন হয়েছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের লিয়াকত-বাবু কমিটিতে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির পক্ষ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দুঃসময়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। সে ব্যক্তিগতভাবে মুজিব সৈনিক এবং শেখ হাসিনার একজন নির্ভীক কর্মী। বর্তমানে নিউমার্কেট থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) হিসেবে কর্মরত আছেন। আমি তার সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।”


এদিকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্যের ওই প্রত্যয়ন পত্রের পাল্টা হিসেবে আশুলিয়া থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ডাবলুর অনুসারীদের পক্ষে পছন্দমতো দফতরে বদলি ও পদায়ন চেয়ে আরেকটি আধা-সরকারি পত্র (ডিও লেটার) ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল শাখার প্যাডে সাবেক সভাপতি এ কে এম মেজবাহ উদ্দীন স্বাক্ষরিত ওই পত্রে বলা হয়, “আমি এ কে এম মেজবাহ উদ্দীন, এই মর্মে প্রত্যয়ন করছি যে, মোহাম্মদ মনিরুল হক ডাবলু, পিতা মরহুম আব্দুল জলিল মিয়া, সাং- বাহাদুরপুর, থানা। গোয়ালন্দ, জেলা রাজবাড়ী। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সহিত ফলাফল করে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয়বাদী ছাত্রদল মেজবাহ ইউনুস কমিটির (হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একজন কর্মী হিসেবে দুঃসময়ে দলের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে ও পারিবারিকভাবে সে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর আদর্শ সৈনিক। তিনি পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশ, কুয়াকাটায় কর্মরত আছে। আমি তার সার্বিক সাফল্য কামনা করি।”

এই পত্র নিয়েও সমালোচনায় মুখর নেটিজেনদের অনেকে। সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে নিজেদের পছন্দমতো দফতরে বদলি ও পদায়ন চেয়ে আধা-সরকারি পত্র (ডিও লেটার) বা মৌখিকভাবে অনুরোধ কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী অপরাধ উল্লেখ করে গত ১১ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক অফিস আদেশ জারি করে।

ওই আদেশে বলা হয়, ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কিছু কর্মকর্তা তাদের পছন্দ অনুযায়ী বদলির জন্য উপদেষ্টা, সিনিয়র সচিব, সচিব বা অন্য পর্যায় থেকে আধা-সরকারি পত্র বা মৌখিকভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করছেন, যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর ২০ এর পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে,আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ডাবলু বলেন, ‘আমরা বিএনপি পরিবারের সদস্য। যে দুটি সুপারিশ নিয়ে আলোচনা চলছে তার মধ্যে একটি সত্য। ছাত্রলীগের যে দাবি, সেটি অসত্য। বাবা শহীদ জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া জাগো দল ও বিএনপি নেতা ছিলেন। বড় ভাই জিয়াউল হক বাবলু পৌর বিএনপি, গোয়ালন্দ শাখার সহ-সভাপতি ও গোয়ালন্দ উপজেলা শাখা জাসাসের সাবেক সভাপতি আর মেঝ ভাই জহিরুল হক লাভলু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গোয়ালন্দ উপজেলা শাখা সাবেক সভাপতি ছিলেন। আর আমি নিজে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। পাশাপাশি হাওয়া ভবন কর্তৃক ২০০১ইং সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন মনিটরিং কমিটির সদস্য ছিলাম।’


মনিরুল ইসলাম ডাবলু আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্যাডে যেটা বানাইছে, ওটা হলে তো আমি বড় বড় জায়গায় ওসিগিরি করতে পারতাম। ট্যুরিস্ট পুলিশে ছিলাম। তার আগে ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। আমি জীবনে একটা ভাল পোস্টিং পাই নাই। জাস্ট আশুলিয়ায় ছয় মাস ছিলাম। তাও ছাত্রলীগের তিনটারে মারছিলাম। তৎক্ষনাৎ সিআইডিতে দিয়ে দেয়। একটা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যেতে অনেক বছর রাজনীতি করতে হয়। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।

আমি ওসি হওয়ার পর আদালতে ছিলাম, তারপর আশুলিয়া, এরপর সিআইডিতে গেলাম। তারপর ডিএমপি কোর্ট ইন্সপেক্টর। এরপর উত্তরা পূর্ব থানায় ৯ মাস, নিউমার্কেট থানায় ওসি (অপারেশন) ছিলাম। এরপর বদলী হয় ঢাকা রেঞ্জে। সেখানে পোস্টিং না দিয়ে লাইনে রাখল। অমানবিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিলাম। এরপর ট্যুরিস্ট পুলিশে দিল। ছিলাম কুয়াকাটায়। এরপর ট্যুরিস্ট সাভার-আশুলিয়ায়। এর মাসখানেক আগে ঢাকা রেঞ্জে এলাম। তারপর ঢাকা জেলা হয়ে আশুলিয়া থানায় ওসি যোগদান করার পর থেকে একটি মহল আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মন্তব্য করতে চাননি। সম্প্রতি পুলিশ সংস্কার কমিশনের করা ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক জনমত জরিপের ফলাফলেসর্বাধিক মতামত পড়েছে দুটি ক্ষেত্রে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ চাই (৮৮.৭%)। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আইনের প্রতি অনুগত বা নিরপেক্ষ পুলিশ (৮৬.২%)।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে আশুলিয়া থানার মতো গুরুত্বপূর্ণ থানায় পোস্টিং এ আওয়ামী লীগের প্রত্যয়ন পত্র প্রকাশ্যে আসা এবং তা আড়াল করতে ছাত্রদল নেতার প্রত্যয়ন পত্রের বিষয়টি ভাল চোখে দেখছেন না পুলিশসহ সচেতন নাগরিক কমিটির অনেকেই। গত ২০ অক্টোবর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এক পত্রে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে (এসবি) আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই করার নির্দেশনা দেয়।

ওই পত্রে প্রাথমিক তথ্যের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের ফেসবুক আইডি, মোবাইল নম্বর, ই-মেইল অ্যাড্রেস এবং তাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার তথ্য চাওয়া হয়। তবে রাজনৈতিক খোলস পাল্টানোর প্রবণতা পুলিশকে কতটা নিরপেক্ষ এবং প্রভাব মুক্ত রাখবে সেটা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন নেটিজনরা।