যে কারনে নাহিদ ইসলামকেই নেতা হিসেবে বেছে নিলো নতুন দল এনসিপি

যে কারনে নাহিদ ইসলামকেই নেতা হিসেবে বেছে নিলো নতুন দল এনসিপি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দলের নাম রাখা হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি – এনসিপি) এবং এই দলের শীর্ষ পদ অর্থাৎ আহ্বায়ক হয়েছেন নাহিদ ইসলাম।


গত কয়েক মাস ধরেই এই নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। দলীয় পদ-পদবি নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিভেদের খবরে গত কয়েকদিনে এই আলোচনা আরও তীব্র হয়েছে। তবে শুরু থেকেই একটি বিষয়ে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিভেদের কথা কোনো তরফ থেকেই শোনা যায়নি। তা হলো— নাহিদ ইসলামই হবেন এই নতুন দলের প্রধান।


জাতীয় নাগরিক কমিটির শীর্ষ নেতারা এর আগে একাধিকবার এ তথ্য জানিয়েছেন।

যদিও বয়সের বিবেচনায় নাহিদ ইসলাম তার সমসাময়িকদের তুলনায় অনেকটাই তরুণ। তবুও দলনেতা হিসাবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন?


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলো
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলো

নাহিদ ইসলাম সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

২৬ বছর বয়সী নাহিদ ইসলামের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং পড়াশোনা— পুরোটাই ঢাকায়। ২০১৪ সালে ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রী মডেল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এরপর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে ২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করেন ২০২২ সালে। এরপর তিনি একই বিভাগে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। তার বিভাগের একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, নাহিদ ইসলাম এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন ইস্যুতে তাকে আন্দোলনে দেখা গেছে।

তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা জানিয়েছেন, তিনি বিভিন্ন পাঠচক্রের সাথেও যুক্ত ছিলেন। সবার আলোচনায় যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হলো– নাহিদ ইসলামের রাজনৈতিক সক্রিয়তা দৃশ্যমান হয়েছে মূলত ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের পর থেকে। যদিও তখন তিনি নেতৃত্বে ছিলেন না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সেসময় পুলিশ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দু'জনকে তুলে নিলে নাহিদ তার প্রতিবাদ করেন। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছিলো তাকে।

এরপর, ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সেসময় বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ তথা নুরুল-রাশেদ-ফারুক প্যানেল থেকে তিনি সংস্কৃতি সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন।যদিও সেই নির্বাচনে তিনি জয়ী হননি।

পরবর্তীতে মতবিরোধের কারণে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ২০২৩ সালের চৌঠা অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করা নির্দলীয় ছাত্র সংগঠন 'গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি'র কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে যোগ দেন।

এর ঠিক পরের বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'- এর এক নম্বর সমন্বয়ক হিসাবে তিনি আবার আলোচনায় আসেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। পরবর্তীতে তা বিভিন্ন বাঁক বদল করে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। শিক্ষার্থী-জনতার সম্মিলনে টানা ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী ওই আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের পতন হয়।

নাহিদ ইসলাম

গত বছরের অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার থেকে শেখ হাসিনা ও তৎকালীন সরকারের পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা দেন এই নাহিদ ইসলাম। সেই ঘোষণার একদিন পর, পাঁচই অগাস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর আসে।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন নাহিদ। পরদিন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। এবং, ১৬ অগাস্ট তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পান। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দলে যোগদানের লক্ষ্যে তিনি ছয় মাসের মাথায়, চলতি বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।

জুলাইয়ে নির্যাতনের শিকার হন নাহিদ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আন্দোলন চলাকালে গত জুলাইয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। পরবর্তীতে তিনি অভিযোগ করেন তাকে চোখ বেঁধে রেখে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।

গত ২২শে জুলাই হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ডিবি পরিচয়ে কোনও একটি 'রাষ্ট্রীয় বাহিনী' তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো।

তার ভাষ্য ছিল, ‘আঘাতের কারণে আমার দুই কাঁধ ও বাম পায়ের রক্ত জমাট বেঁধে আছে। শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও নির্যাতন করা হয়েছে আমাকে।’

গত ২০শে জুলাই শুক্রবার মধ্যরাতে নন্দীপাড়ার এক বন্ধুর বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আন্দোলনে আমি যাতে নেতৃত্ব বা নির্দেশনা দিতে না পারি, সে কারণেই হয়তো আমাকে তুলে নেওয়া হয়েছিলো।’

নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, তুলে নিয়ে যাওয়ায় সময় ওই বাসার নিচে পুলিশ ও বিজিবির গাড়িসহ তিন-চারটি গাড়ি ছিল। সেখানে থাকা একটি প্রাইভেট কার বা মাইক্রোতে তাকে ওঠানো হয়।

‘সে সময় তিন থেকে চার স্তরের কাপড় দিয়ে আমার চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়। কিছু সময় পর গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাকে একটি বাড়ির রুমে নেওয়া হয়। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পরবর্তীতে আমার উপর মানসিক ও শারীরিক টর্চার শুরু করা হয়।’

এক পর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং এরপরের কোনও স্মৃতি নেই বলে জানান নাহিদ। নাহিদ তখন এও বলেন, ‘রোববার ভোরে চারটা থেকে পাঁচটার দিকে পূর্বাচল এলাকায় আমার জ্ঞান ফেরে। পরে আলো ফুটলে কিছু দূর হেঁটে একটি সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে আসি।’ পরে সেখান থেকে হাসপাতালে যান তিনি।

নাহিদ ইসলামের এই অভিযোগের বিষয়ে তখন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে নাহিদকে আটক বা ছেড়ে দেয়া সম্পর্কে কিছু জানেন না।

এই ঘটনার পরপরই নাহিদ ইসলামসহ আরও কয়েকজনকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের 'হেফাজতে' থাকা অবস্থায় কর্মসূচি প্রত্যাহার করার একটি ভিডিও বার্তা দিতে দেখা গিয়েছিলো আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে। পরে ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পাবার পর তিনি বলেছিলেন, ওই বার্তা বাধ্য হয়ে দিয়েছিলেন।

গত তেসরা অগাস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা দিয়েছিলো নাহিদ ইসলাম

দলের নেতা হিসেবে নাহিদই কেন?

জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব মনে করেন, ‘সাংগঠনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও জনগণের সাথে ডিলিং’— যাদের মাঝে একইসাথে এই তিনটি দক্ষতা উপস্থিতি থাকে, রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে তারাই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। নাহিদ ইসলামের মাঝে ‘আন্দোলনের প্রথম থেকেই ওই তিনটি জিনিসের যথাযথ মেলবন্ধন আছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই কারণেই তার নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য হয়েছে।’

আদীব আরও বলেন, নাহিদ ইসলাম সবার জন্য ‘ছাতার (আমব্রেলা) মতো’ এবং ‘রাজনীতি ও জনগণের মেলবন্ধনটা তিনি ভালোভাবে প্লে করতে পারেন’।

জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-মুখপাত্র মুশফিক উস সালেহীনের সাথেও এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের আহ্বানটা নাহিদ ইসলাম দিয়েছিলো। গণঅভ্যুত্থানের আইকন বলা যায় তাকে। গণঅভ্যুত্থানের পরে যেহেতু ওই চেতনাকেই ধারণ করে দল গঠিত হচ্ছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই নাহিদ ইসলাম এখানে প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেন,’ যোগ করেন তিনি।

নতুন দলের প্রধান সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে একই প্রশ্ন তাকেও করা হলে বলেন, এটি ‘সম্পূর্ণভাবে স্ট্র্যাটেজিক্যাল’ কারণে করা হয়েছে। এমনিতে আমাদের রাজনীতি কালেক্টিভ। নাহিদ ইসলামকে যদি বলা হয়, তুমি সদস্য হিসাবে থাকবা, সে সদস্য হিসাবে থাকবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘তাকে আমরা কোটা আন্দোলন থেকে দেখছি। আস্তে আস্তে সে নিজেকে তৈরি করেছে। তিনি অনেকের মাঝে তার জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি ক্ষমতা থেকে বের হয়ে দল তৈরি করেছেন। তিনি বলেছেন যে তিনি রাজপথে মানুষের সাথেই থাকতে চান। একজন নেতা হিসাবে মানুষের সাথে থাকার যে প্রতিশ্রুতি, তা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা খুব কম ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবের সময়ও হয়েছে। সোহেল তাজের বেলায়ও হয়েছে, যদিও অনেকে বলেন যে সোহেল তাজকে বাধ্য করা হয়েছে। নাহিদের ক্ষেত্রে সে নিজেই এই স্পেস তৈরি করেছে।’

কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে নাহিদ ইসলামের উপর যে নিপীড়ন হয়েছে, এতে তিনি আরও বেশি ‘পরীক্ষিত নেতা হয়ে উঠেছেন’ বলে মনে করেন এই শিক্ষক।

‘তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, ছাত্রদের পালস বোঝার চেষ্টা করেছেন। অন্যদের চাইতে তিনি ভিন্নভাবে এটা ধরতে পেরেছেন। সেটি তার শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।’

তবে নতুন দলের নেতৃত্ব নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়নি মনে করলেও নাসরীন বলছেন, ‘সবাই তার বিষয়ে একমত হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে তার বিরোধিতা কেউ করেনি। কারণ মতাদর্শিক পরিসরে দেখলে তিনিই এই আন্দোলনের মূল শক্তি।৯