যাত্রার বিবেক সাজবেন যেভাবে

উল্টো–পাল্টা কিছু ঘটে গেলেই আমরা বিবেকের কাছে চলে যাই। ধরুন, কারও কোনো কাজ আমাদের পছন্দ হলো না। অথবা সেটিকে ন্যায় মনে হলো না। তখনই বলে উঠি যে, ‘আপনার বিবেক কী বলে?’। অথবা প্রায় সময়ই বিবেককে প্রশ্ন করতেও বলা হয়। সাধারণভাবেই এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে বলে, বিবেকের কাছে ইতিমধ্যেই প্রশ্নের এভারেস্টের চেয়েও হাজারগুণ উঁচু পাহাড় তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত! তবে বিবেকের কাছে প্রশ্নের পাহাড় যেন আরও বেশি উঁচু হয়ে না যায়, সেজন্য কিছু মানুষ বরাবরই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। নিশ্চয়ই তাদের কাঁধের সাইজ বড়। নইলে তো এত গুরুদায়িত্ব নেওয়া যায় না। বিবেক এখনও পর্যন্ত মানুষের সম্পত্তি। অন্তত এই পৃথিবীর মানুষ তেমনটাই দাবি করে থাকে। তেমনই কিছু মানুষ বিবেক সাজার কাজটি করে ফেলে। এবং নসিহত দেয় নানা ধরনের। এক ধরনের ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেওয়া হয়। এতে কিন্তু ঝামেলাও অনেক সময়ে কমে যায়।
বিশেষ করে, বন্ধু–বান্ধবের ক্যাঁচালে কিছু বন্ধু থাকেই, যারা নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করার চেষ্টা করে। এক ধরনের ন্যায়ের প্রতীক হয়ে ওঠে তারা। কখনও এতে ক্যাঁচাল কমে, আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্যাঁচাল থেকে যায় ক্যাঁচালের মতো করেই। কেবলই কিছু ‘বাণী’ শোনানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে ক্যাঁচাল যা হওয়ার আগেই হয়ে যায়। তখন কেবলই ‘টেকনিক্যালি কারেক্ট’ থাকার হিসাবে কোনো বন্ধু হয়তো বলে বসে, ‘নাহ্, এটা ঠিক হয়নি।’ তখন হয়তো বিপক্ষ বলে বসে, ‘তাই তো আমি এটা করসি।’ তখন আবার ওই ‘টেকনিক্যালি কারেক্ট’ থাকার হিসাব করা ব্যক্তিটি বলে বসে, ‘না, না, এটাও করা যায় না।’
! ঠিক এভাবেই যে ব্যক্তিটি নিজেকে ‘সবার ওপরে’ বসিয়ে ফেলেন এবং সেখান থেকে আর নেমে আসার পথ খুঁজে পান না, এবং তাতে কারওরই যখন কিছু যায়–আসে না, কেউ পাত্তাও দিতে চায় না, তখনই সৃষ্টি হয়ে যায় ‘যাত্রার বিবেক’। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই এ বঙ্গের যাত্রাপালায় এমন বিবেকের শরীরী দেখা মেলে। তবে এর ‘অশরীরী’ দেখা মেলে আরও বেশি বেশি করে। আপনারা যেমন বন্ধু–বান্ধবের মহলে এমন বিবেক পাবেন, তেমনি পাবেন পরিবারে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, আরও কত কত স্থানে! আর নাটক–সিনেমায় তো একেবারেই নিত্যকার দেখা মেলে। ‘যাত্রার বিবেক’ হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, যে কাউকে সমালোচনা করা যায়, পরামর্শও দেওয়া যায় দেদারসে। কেউ মানুক, আর না মানুক—আপনি আপনার কথা বলে গেলেন আর কি! এতে সুবিধা হলো, দোষের ভাগ কখনও নিতে হয় না, দায়িত্বও কখনো নিতে হয় না।
একেবারে নির্দোষের ভান ধরে থাকা যায়, দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়েও দেওয়া যায় নির্দ্বিধায়। আর দায় নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সুবিধা অনেক আসলে। মানে একেবারে বিন্দাস লাইফ যাকে বলে! তো, এমন ‘যাত্রার বিবেক’ সাজার ইচ্ছা আমাদের অনেকেরই হয়। আরামের এমন জীবন কে না চায়! কিন্তু সব কিছুরই একটা প্রক্রিয়া থাকে, একটা ফরমুলা থাকে। এটা জানা না থাকায়, অনেকেই জীবনের ব্যর্থতার চোরাগলিতে হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা করে ফেলে। এবার আমরা সেই ফরমুলাই জেনে নেওয়ার চেষ্টাটা করব। তাই চলুন, জেনে নেওয়া যাক, যাত্রার বিবেক সাজার উপায়গুলো।১ম উপায়: ঘটনা বা ক্যাঁচাল যখন ঘটবে, তখন কিচ্ছু বলা যাবে না। মুখে একেবারে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজনে স্ট্যাপলার বা সেফটিপিনও ব্যবহার করা যায়। এতে যেটা হয়, মুখ খুলতে গেলেই যেহেতু ব্যথা লাগবে, তাই আর খোলাও হবে না। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন, সেটি হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ।
প্রাথমিকভাবে স্কচটেপ, স্ট্যাপলার বা সেফটিপিন ব্যবহার করলেও, ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে যাওয়াই হতে হবে মূল লক্ষ্য। আর এভাবেই ঘটনা ঘটার স্পিকটি নট হয়ে থাকতে হবে। এমনভাবে এই কাজটা করতে হবে, যেন আশপাশের সবাই ভুলেই যায় যে, আপনি কথা বলতে জানেন! ২য় উপায়: ঘটনা বা ক্যাঁচাল প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর বা অনেকখানি ঘটে যাওয়ার পর, যখন কারও কোনো আলাপে আর কোনো কিছু যায়–আসবে না, ঠিক তখন মুখ খুলতে হবে। প্রত্যক্ষভাবে মুখ খোলা না গেলে, হাত খুলতে হবে। বিবৃতি ঘরানার কিছু দিতে হবে। আর এই বিবৃতিটাও এমনভাবে দিতে হবে, যেন আদৌ ক্যাঁচাল ঘটেছে কিনা, তা নিয়ে আপনার বক্তব্য শুনে বা পড়ে সবাই ধন্ধে পড়ে যায়। অর্থাৎ, একেবারে সারপ্রাইজ দিয়ে দিতে হবে। এই কর্মকাণ্ডে আপনি ছাড়া সবাই যেন অবাক হতে বাধ্য হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে! ৩য় উপায়: ক্যাঁচাল প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর বা অনেকখানি ঘটে যাওয়ার পর, যখন ‘নীতিবাক্য’গুলো ঝাড়বেন, তখন একবার ঝেড়েই ফেলে দেওয়া যাবে না। বার বার ঝাড়তে হবে। পারলে শক্তপোক্ত ঝাড়ু কিনে এনে ঝাড়তে হবে।
এভাবে বার বার এক বক্তব্য দিতে দিতে সেটিকে সম্পাদ্য বা উপপাদ্যের শেষাংশের ‘প্রমাণিত’ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, বাস্তবতা সব সময় বদলানো যায় না। কিন্তু বাস্তবতা যেভাবে নির্ধারিত হয়, সেই প্রক্রিয়া যারা অনুসরণ করে, তাদের মাথাতেই যদি তালগোল পাকিয়ে দেওয়া যায়, তবে সবাই বিভ্রান্ত হতে থাকবে। সুতরাং, মন বদল করে দিতে হবে। বদলাতে না পারলে সব আওলা–ঝাওলা করে দিতে হবে। দেখবেন বাস্তবতা এমনিতেই বদলে গেছে!৪র্থ উপায়: সবশেষে, অবশ্যই নিজের অবস্থানকে এমন ‘উচ্চতা’য় নিয়ে যেতে হবে, যাতে আপনাকে কোনো পক্ষেই ফেলা না যায়। অর্থাৎ, কোনো অবস্থানই আসলে থাকবে না। ডানে যেতে গেলেও ‘না’, বামেও ‘না’, মধ্যেও বলতে হবে ‘না’। পল্টি দেওয়ার অভ্যাসও থাকতে হবে। অর্থাৎ, এমন বেটাইমে এমন একটা আজাইরা আলাপ চালাতে হবে, যেন গালি দেওয়ার শক্তিও না পায় কেউ। স্রেফ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে সবাই। হতাশ তাদের হতেই হবে। আর সেটিই হবে ‘যাত্রার বিবেক’ হিসেবে পাওয়া সার্থক পুরস্কার! আশা করা যায়, ওপরের উপায়গুলো অনুসরণ করলে একজন আদর্শ ‘যাত্রার বিবেক’ হয়ে উঠতে পারবে যে কেউ। তখন জীবনে থাকবে শুধু সুবিধা ও আরাম। তাহলে আর দেরি কেন? মুখে রঙ মেখে রেডি হয়েই যান বরং! গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠুন— ‘বিবেক, তুমি কুতায়?’