ভারতের লাদাখের কিছু অংশ দখলে নিলো চীন

স্বায়ত্তশাসিত জিনজিয়াং প্রদেশে সম্প্রতি হিআন ও হেকাং নামে দুটি প্রশাসনিক অঞ্চল (কাউন্টি নামে পরিচিত) তৈরির ঘোষণা দিয়েছে চীন। যেগুলোতে ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখের কিছু অংশ জুড়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভারত-চীন সীমান্ত।
চীনের সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানায়, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং রাজ্য পরিষদ এরই মধ্যে নতুন কাউন্টি দুটির অনুমোদন দিয়েছে। নতুন প্রশাসনিক অঞ্চল দুটি চীনের হোতান প্রশাসনিক অঞ্চল নামে পরিচালিত হবে। কিন্তু এই অঞ্চল দুটির বেশকিছু অংশ লাদাখে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশটির এ পদক্ষেপের ক্ষোভে ফুঁসছে নয়াদিল্লি। যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘এই তথাকথিত কাউন্টির কিছু অংশ লাদাখের ভেতরে পড়ে এবং ভারত কখনই এই এলাকায় চীনের অবৈধ দখলদারিকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমরা চীনা পক্ষের কাছে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছি।’
পূর্ব লাদাখের সীমান্তবর্তী আকসাই চীনে ভারতের প্রায় ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ছাড়াও পাকিস্তান ১৯৬৩ সালে সাক্সগাম উপত্যকায় ভারতের প্রায় ৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল চীনের কাছে হস্তান্তর করে। অন্যদিকে বেইজিং ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে চীনের ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করে আসছে। অধিকৃত তিব্বতের ওপর সার্বভৌমত্বের দাবির ভিত্তিতে এটিকে ‘জাংনান’ (দক্ষিণ তিব্বত) বলে অভিহিত করে তারা। এ ছাড়া বেইজিং ভারতের হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড রাজ্যে ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করে।
লাদাখে চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধ বহু পুরোনো। ওই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে শান্ত থাকার পর কয়েক বছর আগে ওই সীমান্ত নিয়ে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়। ২০২০ সালের ১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। লোহার রড ও কাঁটাতার জড়ানো হাতিয়ার নিয়ে হামলা চালায় চীনা সেনারা। রক্তক্ষয়ী সেই সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হন। ১৯৭৫ সালে পর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় প্রাণহানির প্রথম ঘটনা ছিল এটা। সংঘর্ষের পরই সীমান্তে কার্যত যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরিস্থিতি শান্ত করতে কয়েক দফা আলোচনায় বসে দুই দেশের সেনাবাহিনী।
গত বছর একাধিক কূটনৈতিক বৈঠকের মাধ্যমে উত্তেজনা কিছুটা কমে। এরপর গত অক্টোবরে পূর্ব লাদাখের বিরোধপূর্ণ ডেপস্যাং ও ডেমচকেই থেকে দুই দেশের সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়। সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছিলেন, পূর্ব লাদাখের বিতর্কিত এলাকার উত্তেজনা প্রশমনে ভারত ও চীনের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে। সেই বোঝাপড়া অনুযায়ী দুই দেশ এলএসিতে টহলদারি করবে ও নজরদারি রাখাবে। ওই বোঝাপড়া মেনেই পরবর্তী সময়ে সেনা অপসারণের কাজ শুরু হবে এবং ২০২০ সালে এপ্রিল মাসে এলএসিতে সেনানীদের যে অবস্থান ছিল, সেখানে দুই দেশের সেনাবাহিনী ফিরে যাবে।
এরপর রাশিয়ার কাজানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেডিসেন্ট শি জিন পিং বৈঠক করেন। সংঘাতের ওই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর এই শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হয়। তারা বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেননি। পৃথকভাবে দেওয়া দুই দেশের বিবৃতিতে যথেষ্ট ফারাকও দেখা যায়। ভারতের বিবৃতিতে যাকে ‘চুক্তি’ বলা হয়েছে, চীনের বিবৃতিতে তা ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’। চীনের দাবি, সীমান্ত বিবাদের মীমাংসার বিষয় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হওয়া উচিত নয়। এর পাল্টা ভারতের বক্তব্য, সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে, স্থিতাবস্থা না ফিরলে বাণিজ্যিক বা অন্য সম্পর্কও সাবলীল হতে পারে না।
সীমান্ত বিতর্ক ঘিরে দুই দেশ নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকলেও আলাপ-আলোচনার দরজা কখনো বন্ধ হয়নি। সীমান্ত সমস্যার সমাধানে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গত পাঁচ বছরে বিশটির বেশি বৈঠক হয়েছে। কূটনৈতিক স্তরেও আলোচনা অব্যাহত থেকেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও চলেছে নানা বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও। আড়ষ্টতা সত্ত্বেও চীন-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বহরে যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাপিয়ে গেছে চীন। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারত-চীন মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১১৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। যদিও চীনে ভারতের রপ্তানি ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যঘাটতি এই মুহূর্তে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
চীনের চাহিদামতো বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ ভারত তুলে নিলে বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। টেলিকমসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো উন্মুক্ত হবে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতীয় শিল্প মহলেরও চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। বিশেষজ্ঞ মহল যদিও এই বিষয়ে ভারতকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়টি গভীর বিবেচনায় রাখতে বলেছে।
গত বছরের শেষদিকের ওই সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে আশা করা হয়েছিল ভারত-চীনের সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা কমে আসবে। চীনের সাম্প্রতিক ঘোষণা সেই সম্পর্ককে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।