ভুঁইফোঁড় সংগঠন বাড়াচ্ছে বিএনপির দুশ্চিন্তা

ভুঁইফোঁড় সংগঠন বাড়াচ্ছে বিএনপির দুশ্চিন্তা

দলীয়ভাবে কঠোর হুঁশিয়ারির পরও বিএনপি তথা ‘জাতীয়তাবাদী’ শব্দ ব্যবহার করে নামসর্বস্ব অসংখ্য ভুঁইফোঁড় সংগঠনের কার্যক্রম থেমে নেই। বিএনপিকে ঘিরে ভুঁইফোঁড়দের যেন ‘রমরমা’ অবস্থা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ‘জাতীয়তাবাদী’ বা ‘জিয়া’র নাম যুক্ত করে সংগঠনের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ক্ষমতার স্বাদ পেতে অনুপ্রবেশ ও নামসর্বস্ব সংগঠন করেই অনেকে নেতা বনে যাচ্ছেন। যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি নেই। সেইসঙ্গে কর্মসূচি আয়োজনের নামে কোনো কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে এসব সংগঠনের হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অন্যদের কোথাও দেখা যায়নি। বিগত আন্দোলনে বেশকিছু সংগঠনের তৎপরতা দেখা গেলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলে আবারও নতুনভাবে মাথাচড়া দিচ্ছে ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো। মূলত সুবিধাবাদীরা বিএনপি, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে সংগঠন করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তায় বিএনপির হাইকমান্ড। একপর্যায়ে গত ২৪ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী বা বিএনপির নাম যুক্ত করে কোনো সংগঠন করতে দলীয়ভাবে নিষেধ করা হয়েছে। তবুও বিএনপির কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকে এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রিকশা-ভ্যান-অটোচালক’ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার কয়েক বছর চুপচাপ থাকা সংগঠনগুলো নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর আগে দলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সব ধরনের যোগদান কার্যক্রমেও নিষেধাজ্ঞা দেয় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, নামসর্বস্ব ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো মূলত সুসময়ে তৎপরতা দেখায়। কিন্তু খারাপ সময়ে এরা থাকে না।

সংগঠনের কর্ণধার সুযোগ বুঝে বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন। সভা-সমাবেশের নামে অর্থ আয় করা ও ক্ষমতায় গেলে দলীয় নেতাদের কাছে লাভবান হওয়ার চিন্তা থেকেই সংগঠনগুলো গড়ে উঠছে। এর পেছনে দলটির কিছু কেন্দ্রীয় নেতার ভূমিকাও রয়েছে। কেননা, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপি ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনগুলো যখন রাজপথে প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি, তখন এসব ভুঁইফোঁড় অনেক সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি করতে পেরেছিলেন বিএনপি নেতারা। ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, জাতীয়তাবাদী বন্ধু দল, জাতীয়তাবাদী তরুণ দল, জিয়া ব্রিগেড, জিয়া মঞ্চ, দেশনেত্রী পরিষদ, তারেক রহমান পরিষদ, তারেক রহমান মুক্তি পরিষদসহ কিছু সংগঠন দেশব্যাপী বিএনপি, জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা সারা দেশের নেতাকর্মীদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের আমলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ব্যানারে কোনো নেতা কোথাও দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেননি। সেই সময়ে এসব ছোট ছোট সংগঠনের ব্যানারে অনেকে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। বর্তমানে দেখতে হবে যেনতেন কোনো ব্যক্তি যেন জাতীয়তাবাদী নামে সংগঠন করতে না পারে। আমি মনে করি, সংগঠনের নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি, কোন উদ্দেশ্যে আসছে, কেন আসতে চাইছে—এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। দলের নেতারা তাদের গুরুত্ব না দিলে সুবিধা নিতে পারবে না। জানা গেছে, সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রিকশা-ভ্যান-অটোচালক’, ‘বাংলাদেশ নাগরিক অধিকার আন্দোলন’, ‘গণতন্ত্র ফোরাম’, ‘ভয়েস অব টাইমস’সহ কয়েকটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

এরা বিভিন্ন বিষয়ে মানববন্ধন, সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দু-একজন সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, নির্বাহী কমিটির সদস্যরা অংশ নেন। বিএনপির সমর্থক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠা নাম ও প্যাডসর্বস্ব ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোর তৎপরতা মূলত ছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভেতরে ও সামনের সড়কে এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) কেন্দ্রিক। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এখন নয়াপল্টন বিএনপির পার্টি অফিসের সামনেও কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত ২৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে সংগঠন করলেও এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।

 এরা দলের কেউ নন। যদি এসব সংগঠনের সঙ্গে দলের কেউ জড়িত থাকেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জাতীয়তাবাদী নামে কোনো সংগঠন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপির কেউ যদি ভুঁইফোঁড় সংগঠনের ব্যানারে যায়, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা রয়েছে। বিএনপির অঙ্গসহযোগী সংগঠনের বাইরে স্বীকৃত সংগঠনগুলো হচ্ছে শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাব ও শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট, ডাক্তারদের সংগঠন-ড্যাব, ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠন-অ্যাব, কৃষিবিদদের সংগঠন-এ্যাব, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি), মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (এমট্যাব) ও জিয়া স্মৃতি পাঠাগার রয়েছে। সংগঠনের নামের শুরুতে ‘জাতীয়তাবাদী’ শব্দ লাগিয়ে ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয়তাবাদী প্রচার দল, রিকশা-ভ্যান-অটোচালক দল, চালক দল, তরুণ দল, গণতন্ত্র পরিষদ, বাউল দল, প্রজন্ম দল, নাগরিক ফোরাম, নাগরিক দল, মানবাধিকার ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, সেবাদল, বাস্তুহারা দল, সাংস্কৃতিক দল, কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদ, তৃণমূল দল, বন্ধু দল, নতুন বাংলাদেশ এবং ঢাকা ওয়াসা জাতীয়তাবাদী এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নামে নামকরণ করা সংগঠনগুলো হলো ‘জিয়া নাগরিক ফোরাম, জিয়া আদর্শ একাডেমি, জিয়া সেনা, জিয়া স্মৃতি সংসদ, জিয়াউর রহমান সমাজকল্যাণ পরিষদ (জিসপ), জিয়া ব্রিগেড, জিয়া ন্যাশনালিস্ট ফোরাম, শহীদ জিয়াউর রহমান আদর্শ বাস্তবায়ন পরিষদ ও শহীদ জিয়ার ১৯ দফা বাস্তবায়ন পরিষদ। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামে আছে ‘দেশনেত্রী পরিষদ’, ‘খালেদা জিয়া পরিষদ’, ‘তারেক জিয়া ফোরাম’, ‘তারেক পরিষদ’ ও ‘তারেক রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদ’। বিএনপির নাম ব্যবহার করে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমি, সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদ, সচেতন নাগরিক ফোরাম, গণতান্ত্রিক ঐক্য ফোরাম, চেতনায় ৭১, দেশপ্রেমিক মঞ্চ, স্বদেশ জাগরণ ফোরাম, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, হৃদয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম, স্বাধীনতা অধিকার ফোরাম, সুশীল ফোরাম, জাতীয় নাগরিক ফোরাম, বাংলাদেশ নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও বাংলাদেশ নবীন দল অন্যতম।

এর আগে ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোর মধ্যে ৩৮টি সংগঠন মিলে ‘বিএনপির সহযোগী সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ গঠন করা হয়েছিল ২০১৪ সালের আগস্টে, যার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে ‘জি-নাইন (গ্রুপ-২০০৯)’ ও ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামে দুটি সংগঠনকে দলের ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ হিসেবে মর্যাদা দেয় বিএনপি। এই দুটিরও কার্যক্রম এখন প্রায় নেই বললেই চলে। পাশাপাশি নব্বই দশকের ছাত্রনেতাদের করা ‘’৯০-এর ডাকসু সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ সংগঠনটিকেও গুরুত্ব দেয় বিএনপি। এদিকে প্রচার দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগও রয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি মাহফুজ কবির মুক্তা আশ্বাস দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দিতে পারেননি। ফলে বছর তিনেক আগে চেক ডিজঅনার মামলায় কয়েক মাস জেলও খেটেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতাদের কাছে প্রচার করেন যে, তিনি ‘শেখ হাসিনার আমলে সাইবার সিকিউরিটি আইনের মামলায় জেল খেটেছেন’। বর্তমানে বিএনপির সভা-সমাবেশে তার ব্যবহারের কারণে মূল ধারার গণমাধ্যমকর্মীরাও ক্ষুব্ধ। জাতীয়তাবাদী প্রচার দলকে বিএনপির সহযোগী সংগঠন দাবি করে প্রচার দলের আহ্বায়ক মাহফুজ কবির মুক্তা বলেন, ‘তিনি মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর এলাকায় ছাত্রদলের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ফেসবুকে লাইভ দেওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাকে পুরোনো চেক ডিজঅনার মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি বলেন, মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের তিনটি মামলা ছিল। তিনি প্রতিষ্ঠানটির একজন অংশীদার হওয়ায় ওই মামলায় জেল খেটেছেন। মুক্তার দাবি, ২৪ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি রয়েছে তাদের।

 তারাই ‘বিএনপির প্রচার কার্যক্রম’ চালান। এটি আসলে বিএনপির একটি সেল। বিএনপির ফেসবুক পেজসহ সবকিছুই তাদের হাত দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর বিএনপির অফিসিয়াল পেজ চালু করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির মিডিয়া সেলের একাধিক সদস্য জানান, জাতীয়তাবাদী প্রচার দলের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জাতীয়তাবাদী প্রচার দলের কেউ বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা বললে তাকে ধরিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করার কথা বলেন তারা।