ভুয়া নিয়োগের মধ্যমে ১৪ বছর ধরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোস্তাফিজ

বরগুনার বেতাগীতে ফুলতলা মোহাম্মাদিয়া আলিম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ মাওলানা মোস্তাাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে নিজের নিয়োগ,স্বেচ্ছাচারিতা, উপাধ্যক্ষ,কর্মচারি নিয়োগে বানিজ্য,এমপির সাথে কারসাজি,পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতি, উপবৃত্তি, উন্নয়ন তহবিলের অর্থ আত্মসাতসহ সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, অধ্যক্ষ মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দলীয় নেতাদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়ে তথ্য গোপন করে চাকরি এমপিওভ’ক্তি করেন।
নিজে অবৈধ হয়েও উপাধ্যক্ষ,কম্পিউটার অপারেটর (ছাত্রলীগ কর্মী বশির হোসেন), হিসাবসহকারী (যুবলীগ কর্মী ও মাদ্রাসা সভাপতির আপন ছোট ভাই ইমরান বিশ্বাস) ও অফিস সহায়ক পদে (ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন)কে নিয়োগ দিয়ে ৩৭ লক্ষ টাকার বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ,সরকারি ল্যাপটপ, ভুয়া বিল ভাউচারে মাদ্রাসা ফান্ডের অর্থ হরিলুট, বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের নামে সরকারী তহবিলের কোটি টাকা আত্মসাত করে আসছেন।
পুলিশ নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীণ করাতে অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান হাবিবুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থীর রেজাল্টে জালিয়াতির মাধ্যমে ১.৩৩ গ্রেড পরির্বতন করে ২.৫৮ -বানিয়ে প্রত্যয়ন দেয়। তার এ সুকীর্তি যা এখন সবার মুখে মুখে। পরবর্তীতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে তার সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনের জন্য পাঠালে সঠিক নয় বলে জানালে পুলিশ এই জালিয়াতির কপি হাতে পেয়ে বরগুনা জেলার আর ও-২ রিজার্ভ অফিস পুলিশ এ এস আই মোঃ সোহেল খান বাদী হয়ে মূল প্রতারক মোস্তাফিজুর রহমান এর সাথে মোটা অংকের ঘুষ বিনিময়ের মাধ্যমে তার নাম বাদ দিয়ে ছাত্র মোঃ হাবিবুর রহমান (৩১) কে এক নম্বর আসামী করে ২/৩ জনকে অজ্ঞাত করে মামলা করে।মামলার ধারা ৪২০,৪৬৮,৪৭১,১০৯ পেনাল কোর্ট এ
কারসাজি করে বরগুনা-২ আসনের সাবেক এমপি সুলতানা নাদিরার কাছ থেকে ডিউ লেটার নিয়ে ফেইক রেজুলিউশন তৈরি করে জালিয়াতির মাধ্যমে ৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ঢাকায় অবস্থানরত মাসুম বিশ্বাস নামের যুবলীগের কর্মীকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেন। অন্তবর্তীকালীণ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমানে ঐ কমিটি ভেঙে দেওয়া হলেও তোলপাড়ের সৃষ্টি হওয়ায় এমপি সুলতানা নাদিরা ২০২৪ সালের ৫ জুন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নিকট অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে চিঠি দেন।
ফুলতলা মাদ্রাসা সূত্র জানায়, ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানের গভার্ণিং বডি (এডহক) মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমানকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। যা বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা (গভার্ণিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি) প্রবিধানমালা ২০০৯-এর ৪১(২) / (খ) ৪ আদেশ অনুযায়ী অবৈধ। কেননা প্রবিধানে বলা হয়েছে এ্যাডহক কমিটি কোন নিয়োগ দিতে পারবেন না।
এছাড়াও প্রবিধানে আরও উল্লেখ রয়েছে যে,অতীব জরুরি কার্য সম্পাদনে ২৪ ঘন্টা সময়ের ব্যাবধান রেখে দুটি রেজুলেউশন করার বিধান থাকলেও তা না মেনে ৫ ঘন্টার ব্যাবধানে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ২টি রেজুলেউশন করে এডহক কমিটি তার নিয়োগ অনুমোদন করেন ।
মাদ্রাসা গভার্ণিং বডির অভিভাবক সদস্য আবুল কালাম অভিযোগ করেন, ২০০৯ সালে অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা একে এম আব্দুস সত্তার মিয়ার অবসর গ্রহনে তার পদে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করতেন ওই প্রতিষ্ঠানের আরবি বিভাগের প্রভাষক মাওলানা মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে এডহক কমিটির মাধ্যমে অধ্যক্ষ পদে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ অবৈধ নিয়োগ দেন।
এ নিয়ে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১ লা জুলাই মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগের প্রেক্ষিতে একই বছরের ১৫ জুলাই মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের রেজিষ্টার প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান এ বিষয় সরেজমিনে তদন্ত পূর্বক মতামত প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য ইউএনওকে চিঠি প্রদান এবং স্থানীয়রাও লিখিত অভিযোগ করেন।
প্রতিষ্ঠানের জমিদাতা মো: নেছার উদ্দিন জানান, এর আগে তিনি বাদী হয়ে অধ্যক্ষ মোস্তাাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের আওতায় বরগুনায় সহকারি জজ আদালতে একটি মামলা করেন। তাছাড়া চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির কাছেও তিনি লিখিত অভিযোগ করেছেন। যার তদন্ত প্রতিবেদন এখনো প্রক্রিয়াধীন।
অবশ্য বেতাগী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস কার্যালয় সূত্র জানায়, এডহক কমিটি নিয়োগের মত নীতিগত সিদ্ধান্ত কখনোই নিতে পারেন না। এই কমিটির আওতায় কোন নিয়োগই বৈধ বলে বিবেচিত হবেনা।
একাধিক বঞ্চিত ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন, তবুও তৎকালীণসময় অধ্যক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে নিয়োগ বোর্ড ঐ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষা না নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে তৎকালীণ বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এবি.এম.গোলাম কবিরের কার্যালয় বসে নিয়োগ পরীক্ষা নেন।
বেতাগী উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: মহসীন খান বলেন,‘বৈষম্য ও প্রতিষ্ঠানের অন্ধকার কালোছায়া ছায়া সরাতে দুর্ণীতির আশ্রয় নেওয়ার কোন সূযোগ নেই। উপজেলা দুপ্রকের কাছে একটি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছে। দুর্নীত দমন কমিশনে যোগাযোগ করে বিষয়টি যাচাই-বাছাই শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে অনুরোধ করা হবে।’
অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপার ভাইজার মো: মাসুদুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগ পত্রটি হাতে পেয়েছি। এখনো তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে ইউএনও মহোদয়ের নিকট প্রতিবেদন পেশ করবো। তবে এডহক কমিটির নিয়োগের বৈধতা নিয়ে যথেষ্ঠ প্রশ্ন রয়েছে, ঐ সময়ে অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া যথার্থ হয়নি প্রাথমিকভাবে এমনটা ধারনা করলেও তদন্তের আগে মন্তব্য করা উচিত নয়।’
উপজেলার মোহাম্মাদিয়া আলিম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ মাওলানা মোস্তাাফিজুর রহমান তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যথাযথ নিয়মের মধেই আমার নিয়োগ হয়েছে। জোর পূর্বক কিংবা বল প্রয়োগ করে আমি এখানে আসিনি। মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ পেয়েছি।
মাদ্রাসা গভার্ণিং বডির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আহমদ জানান,‘আমি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টির সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে ইতোমধ্যে দায়িত্ব দিয়েছি।’