আবেদদের পেছনে আছে আরও রাঘববোয়াল,জেনে নিন তাদের নাম

পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) অধীনে হওয়া নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এমন অপকর্মে শুধু সংস্থাটির উপপরিচালক (ডিডি) বা সহকারী পরিচালকই (এডি) নন, এই সিন্ডিকেটে আরও বড় রাঘববোয়াল থাকতে পারে বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের। দৃশ্যের আড়ালে থাকা সেই রাঘববোয়াল মাঠপর্যায়ের চক্রের ছায়া হয়ে থাকতেন বলে আভাস মিলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রশ্নফাঁসে পিএসসির দুই ডিডি, দুই এডি এবং দুজন অফিস সহায়কসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দায়ের মামলা সিআইডি তদন্ত করছে। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাও পুরো ঘটনা তদন্তে নেমেছে। মূলহোতাদের চিহ্নিত করার জন্য নানা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, গ্রেপ্তার হওয়া দুই ডিডি বা এডিরা প্রশ্নপত্র তৈরি, সরবরাহ বা অন্যান্য কাজে সরাসরি যুক্ত নন। তাই তদন্তকারীরা মনে করছেন, তাদের ওপরে পিএসসিতে ঊর্ধ্বতন কোনো কোনো কর্মকর্তার শেল্টার থাকতে পারে। যারা এসবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই ধরনের কর্মকর্তা কারা, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। তাদের সঙ্গে অফিস কর্মের বাইরে গ্রেপ্তার ডিডি, এডিসহ চক্রের অন্য সদস্যদের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না, সেই বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
সূত্র বলছে, এরই মধ্যে দুই ডিডির ওপরে অন্তত একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে এই চক্রের সদস্য বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তার বিষয়ে আগে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। তার বিষয়ে সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সিআইডির সাইবার অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, সব বিষয়েই তদন্ত চলমান রয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং অন্যান্য সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
গত ৫ জুলাই রেলওয়ে বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পিএসসির ডিডি জাহাঙ্গীর আলম ও আবু জাফর এবং এডি এসএম আলমগীর কবির ও নিখিল চন্দ্র রায়, দুই অফিস সহকারী খলিলুর রহমান ও সাজেদুল ইসলাম, পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ এই সিন্ডিকেটের ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাদের মধ্যে আবেদ আলীসহ ৬ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। অন্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পায় সিআইডি।
সিআইডির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের মনে হচ্ছে, চক্রটি বেশ বড় এবং এদের ওপরেও কেউ থাকতে পারে। সব তথ্যই যাচাই করা হচ্ছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সূত্র বলছে, পিএসসির অধীনে হওয়া বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াও বিসিএস পরীক্ষারও প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে এই চক্রটি। গ্রেপ্তার একজন জানিয়েছেন, ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অন্তত ১০ জনের কাছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়েছেন তারা। তাদের মধ্যে ৭ জন পাস করার পর মৌখিক পরীক্ষায় চারজন বাদ পড়েন, তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও রেলের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়ও তারা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতেন।
ওই সূত্রটি বলছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে এখন পর্যন্ত অর্ধশত ব্যক্তির নাম বেরিয়েছে, যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে এখন চাকরি করছেন। এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। তবে তারা যেহেতু চাকরি করছেন, তাদের বিষয়ে সতর্কভাবে তদন্ত চলছে। নানা প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিএসসির কিছু কর্মকর্তা কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। এজন্য পিএসসির ডিডি আবু জাফর রাজধানীর মালিবাগে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য একটি কোচিং সেন্টার খোলেন। এ ছাড়া এডি আলমগীর কবির রাজধানীর মিরপুর, নওগাঁ ও বগুড়ায় লোকজন দিয়ে কোচিং সেন্টার চালাতেন। এই কোচিং সেন্টারের আড়ালেই মূলত তারা চাকরিপ্রার্থী খুঁজে তাদের সঙ্গে চুক্তি করতেন। এ ছাড়া প্রশ্নফাঁসে জড়িত পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী তার ছেলের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থী খুঁজতেন। এই চক্রটি তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও বিভিন্ন পরীক্ষায় চাকরি দিয়েছেন।
সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কৌশলের বিষয়ে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, নিয়োগ পরীক্ষাগুলোর জন্য চার থেকে ছয়টি সেটে প্রশ্নপত্র তৈরি হতো। পরীক্ষার দিন শুধু এর একটি সেটে পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু তারা প্রস্তাবিত সব সেটের প্রশ্ন ফাঁস করে সমাধানও করে রাখতেন। যে সেটে পরীক্ষা নেওয়া হতো, তখন চুক্তিবদ্ধ প্রার্থীদের সমাধান পৌঁছে দেওয়া হতো।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আরও জানিয়েছেন, আগে সরাসরি প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো। সেই প্রশ্নপত্র চুক্তিবদ্ধ প্রার্থী নিয়ে আরও অনেককে দিতেন। এজন্য তাদের লোকসান হতো এবং ধরা পড়ারও ভয় ছিল। তবে গত কয়েক বছরে কারও হাতে প্রশ্ন দেওয়া হতো না। পরীক্ষার আগের রাতে চুক্তিবদ্ধদের বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে রেখে তাদের প্রশ্নের সমাধান মুখস্থ করানো হতো। কখনো কখনো সম্ভাব্য বিভিন্ন সেটের প্রশ্নের সমাধানও মুখস্থ করানো হতো।
সাভার ও পল্টনের ‘বুথে’ রাখা হয় চাকরিপ্রার্থীদের :
সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ও অন্য আসামিরা রেলওয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, পরীক্ষার দুই রাত আগে চুক্তি করা প্রার্থীদের নিজেদের (চক্রের) ‘রিডিং বুথে’ নিয়ে আসা হতো। সাভারের একটি ভাড়া বাসা ও রাজধানীর পল্টনের কালভার্ট রোডে একটি গুদামে প্রার্থীদের রেখে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হতো।
আবেদ আলী জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ৫ জুলাই রেলওয়ের পরীক্ষা শুরুর আগে তিনি সাভারের রেডিও কলোনিতে বাসা ভাড়া নিয়ে বুথ তৈরি করেছিলেন। দুদিনের জন্য ৪০ হাজার টাকায় কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। এই কক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন চাকরিপ্রার্থীকে রেখে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হয়। প্রতিজনের কাছ থেকে তিনি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। আবেদ আলী প্রশ্নপত্র ও উত্তর নিয়েছিলেন পিএসসির অফিস সহকারী সাজেদুলের কাছ থেকে।
কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও পেয়েছিলেন জানিয়ে আবেদ আলী বলেন, তখন মিরপুরে দুদিনের জন্য একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে বুথ বানান তিনি। সে সময় ৪৪ চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে তিনি ৪ লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন। অন্যান্য সময়ের প্রশ্নফাঁসের তথ্যও দেন তিনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে পিএসসির অফিস সহকারী সাজেদুল জানিয়েছেন রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তিনি পিএসসির এক সদস্যের কক্ষে থাকা ট্রাঙ্ক থেকে পেয়েছিলেন। এই প্রশ্নপত্র সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ও ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমানের কাছে ৭৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। গ্রেপ্তার হওয়া পানি ফিল্টার ব্যবসায়ী সাখাওয়াত জানিয়েছেন, পল্টনের কালভার্ট রোডের একটি বাড়ির দ্বিতীয়তলায় পানির ফিল্টারের গুদাম রয়েছে তাদের। পিএসসির অফিস সহকারী সাজেদুল ইসলাম তার পূর্বপরিচিত হওয়ায় প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করে চাকরিপ্রত্যাশী কেউ থাকলে জানাতে বলতেন তাকে। রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৪ প্রার্থীকে বৃহস্পতিবার তার ওই গুদাম কক্ষে রেখেছিলেন সাজেদুল। সারারাত চাকরিপ্রার্থীরা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরদিন পরীক্ষা দিতে যান।
জবানবন্দিতে পিএসসির অন্য অফিস সহকারী (ডেসপাস রাইডার) খলিলুর রহমান জানিয়েছেন তিনি রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরিপ্রত্যাশী ৫০ জনের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের চেক নিয়েছেন। এই চক্রটি যাদের বুথে ঢুকিয়ে প্রশ্নের সমাধান মুখস্থ করিয়েছে, সবার নামের তালিকা সিআইডির কাছে রয়েছে।
১১ জনকে রিমান্ডে নেওয়ার উদ্যোগ: প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে ৬ জন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্বীকারোক্তি দেওয়া ৬ জন কারাগারে রয়েছেন। তাদের জবানবন্দি এবং তদন্তে পাওয়া তথ্য যাচাই করতে কারাগারে থাকা বাকি ১১ জনকে রিমান্ডে পেতে আজ আদালতে আবেদন করা হবে। তারা হলেন পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী মামুনুর রশীদ, ডেভেলপার ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান নিয়ামুন হাসান।